তার মনে হয় সে যাহা পাইয়াছে জীবনে, তাহাতেই তার জীবন হইয়াছে সার্থক। সে চায় না অর্থ, চায় নাকি সে চায়?
সেটাও তো খুব স্পষ্ট হইয়া উঠে না। সে কি অপরুপ জীবন-পুলক এক একদিন দুপুরের রোদে ছাদটাতে সে অনুভব করে, তাকে অভিভূত, উত্তেজিত করিয়া তোলে, আকাশের দিকে উৎসুক চোখে চাহিয়া থাকে, যেন সে দৈববাণীর প্রত্যাশা করিতেছে।…
কাজল কি একটা বই আগ্রহের সঙ্গে পড়িতেছিল—অপু ঘরে ঢুকিতেই চোখ তুলিয়া ব্যগ্র উৎসাহের সুরে উজ্জ্বলমুখে বলিল-ওঃ, কি চমৎকার গল্পটা বাবা!—শোনো না বাবা-এখানে বোসো–। পরে সে আরও কি সব বলিয়া যাইতে লাগিল। অপু অন্যমনস্ক মনে ভাবিতেছিলবিদেশে যাওয়ার ভাড়া সে জোগাড় করিতে পারে—কিন্তু খোকা—খোকাকে কোথায় রাখিয়া যায়?…মামার বাড়ি পাঠাইয়া দিবে? মন্দ কি? …কিছুদিন না হয় সেখানেই থাকুক-বছর দুই তিন তারপর সে তো ঘুরিয়া আসিবেই। তাই করিবে? মন্দ কি?
কাজল অভিমানের সুরে বলিল—তুমি কিছু শুনছ না, বাবা–
—শুন্ না কেন রে, সব শুনছি। তুই বলে যা না?
—ছাই শুনছে, বলল দিকি শ্বেত পরী কোন্ বাগানে আগে গেল?
বলিল—কোন্ বাগানে?-আচ্ছা একটু আগে থেকে বল্ তো খোকা—ওটা ভালো মনে নেই!
খোকা অতশত ঘোরপ্যাঁচ বুঝিতে পারে না—সে আবার গোড়া হইতে গল্প বলা শুরু করিল—বলিল—এইবার তো রাজকন্যে শেকড় খুঁজতে যাচ্ছে, কেমন না! মনে আছে তো? অপু এক বর্ণও শোনে নাই) তারপর শোনো বাবা–
কাজলের মাথার চুলের কি সুন্দর ছেলেমানুষি গন্ধ!-দোলা, চুষিকাটি, ঝিনুকবাটি, মায়ের কোল—এই সব মনে করাইয়া দেয়—নিতান্ত কচি। সত্যি ওব দিকে চাহিয়া দেখিলে আর চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা হয় না—কি হাসে, কি চোখ দুটি—মুখ কি সুন্দর-ওইটুকু একরত্তি ছেলে—যেন বাস্তব নয়, যেন এ পৃথিবীর নয়—কোন সময় জ্যোৎস্নাপরী আসিয়া ওকে যেন উড়াইয়া লইয়া কোনও স্বপ্নপারের দেশে লইয়া যাইবে দিনরাত কি চঞ্চলতা, কি সব অদ্ভুত খেয়াল ও আবদার অথচ কি অবোধ ও অসহায়!—ওকে কি করিয়া প্রতারণা করা যাইবে?—ও তো একদণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না–ওকে কি বলিয়া ভুলানো যায়? অপু মনে মনে সেই ফন্দিটাই ভাবিতে লাগিল।
ছেলেকে বলিল—চিনি নিয়ে আয় তো খোকা—একটু হালুয়া করি।
কাজল মিনিট দশেক মাত্র বাহিরে গিয়াছে—এমন সময় গলির বাহিরে রাস্তায় কিসের একটা গোলমাল অপুর কানে গেল। বাহির হইয়া ঘরের দোরে দাঁড়াইল–গলির ভিতর হইতে লোক দৌড়াইয়া বাহিবেব দিকে ছুটিতেছে—
একজন বলিল—একটা কে লবি চাপা পড়েছে–
অপু দৌড়িয়া গলির মুখে গেল। বেজায় ভিড়, সবাই আগাইতে চায়, সবাই ঠেলাঠেলি করিতেছে। অপুর পা কাঁপিতেছিল, জিভ শুকাইয়া আসিয়াছে। একজন কে বলিল—কে চাপা পড়েছে মশাই
—ওই যে ওখানে একটা ছেলে—আহা মশায়, তখনই হয়ে গিয়েছে—মাখাটা আর নেই—
অপু রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিল—বয়স কত?
বছর নয় হবে—ভদ্রলোকের ছেলে, বেশ ফরসা দেখতে—আহা!–
অপু এ প্রশ্নটা কিছুতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিল না—তাহার গায়ে কি ছিল। কাজল তার নতুন তৈরি খদ্দরের শার্ট পরিয়া এইমাত্র বাহির হইয়া গিয়াছে—
কিন্তু এই সময়ে হঠাৎ অপু হাতে পায়ে অদ্ভুত ধরনের বল পাইল-বোধ হয় যে খুব ভালোবাসে, সে ছাড়া এমন বল আর কেহ পায় না এমন সময়ে। খোকার কাছে এখনি যাইতে হইবে—যদি একটুও বাঁচিয়া থাকে—সে বোধ হয় জল খাইবে, হয়তো ভয় পাইয়াছে—
ওপারের ফুটপাতে গ্যাসপোস্টের পাশে ট্যাক্সি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, পুলিশ আসিয়াছে–ট্যাক্সিতে ধরাধরি করিয়া দেহটা উঠাইতেছে। অপু ধাক্কা মারিয়া সামনের লোকজনকে হঠাইয়া খানিকটা জায়গা ফাঁকা করিয়া ফেলিল। কিন্তু ফাঁকায় আসিয়া সামনে ট্যাক্সিটার দিকে চাহিয়াই তাহার মাথাটা এমন ঘুরিয়া উঠিল যে, পাশের লোকের কাঁধে নিজের অজ্ঞাতসারে ভর না দিলে সে হয়তো পড়িয়াই যাইত। ট্যাক্সির সামনে যে ভিড় জমিয়াছে তারই মধ্যে দাঁড়াইয়া ডিঙি মারিয়া কাণ্ডটা দেখিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে কাজল। অপু ছুটিয়া গিয়া ছেলের হাত ধরিল-কাজল ভীত অথচ কৌতূহলী চোখে মৃতদেহটা দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল—অপু তাহাকে হাত ধরিয়া লইয়া আসিল। কি দেখছিলি ওখানে?…আয় বাসায়–
অপু অনুভব করিল, তাহার মাথা যেন ঝিমঝিম্ করিতেছে সারা দেহে যেন এইমাত্র কে ইলেকট্রিক ব্যাটারির শক লাগাইয়া দিয়াছে।
গলির পথে কাজল একটু ইতস্তত করিয়া অপ্রতিভের সুরে বলিল–বাবা, গোলমালে আমায় যে সিকিটা দিয়েছিলে চিনি আনতে, কোথায় পড়ে গিয়েছে খুঁজে পাই নি।
-যাক গে। চিনি নিয়ে চলে আসতে পারতিস কোকালে–তুই বড় চঞ্চল ছেলে খোকা।
দিন দুই পরে সে কি কাজে হ্যারিসন রোড দিয়া চিৎপুরের দিকে ট্রামে চড়িয়া যাইতেছিল, মোড়ের কাছে শীলেদের বাড়ির রোকড়নবিশ রামধনবাবুকে ছাতি মাথায় যাইতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি ট্রাম হইতে নামিল, কাছে গিয়া বলিল, কি রামধনবাবু, চিনতে পারেন?
রামধনবাবু হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, আরে অপূর্ববাবু যে! তারপর কোথা থেকে আজ এতকাল পরে! ওঃ, আপনি একটু অন্যরকম দেখতে হয়ে গিয়েছেন, তখন ছিলেন ছোকরা
অপু হাসিয়া বলিল—তা বটে। এদিকেও চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হল-কতকাল আর ছোকরা থাকব-আপনি কোথায় চলেছেন?
—অফিস যাচ্ছি, বেলা প্রায় এগারোটা বাজে–না? একটু দেরি হয়ে গেল। একদিন আসুন? কতদিন তো কাজ করেছেন, আপনার পুরানো অফিস, হঠাৎ চাকরিটা দিলেন ছেড়ে, তা নইলে আজ অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার হতে পারতেন, হরিচরণবাবু মারা গিয়েছেন কিনা।