–সে এখন হবে না, সময় নেই। সুবিধে মতো দেখব।
অপু অনেকগুলি ছেলেমেয়ের খেলনা, খাবার চাটনি কিনিয়া দিল। রসিককে স্টেশনে তুলিয়া দিয়া আসিল। রসিক বলিল-আপনি কিন্তু ঠিক যাবেন একদিন এর মধ্যে–নইলে ওই বললাম যে—
কি চমৎকার নীল আকাশ আজ! গরম আজ একটু কম।
চৈত্র দুপুরের এই ঘন নীল আকাশের দিকে চাহিলেই আজকাল কেন শৈশবের কথাই তাহার মনে পড়ে?
একটা জিনিস সে লক্ষ করিয়াছে। বাল্যে যখন অন্য কোনও স্থানে সে যায় নাই—যখন যাহা পড়িত—মনে মনে তাহার ঘটনাস্থলের কল্পনা করিতে গিয়া নিশ্চিন্দিপুরেরই বাঁশবন, আমবাগান, নদীর ঘাট, কুটির মাঠের ছবি মনে ফুটিয়া উঠিত—তাও আবার তাদের পাড়ার ও তাদের বাড়ির আশেপাশের জায়গার। তাদের বাড়ির পিছনের বাঁশবন তো রামায়ণ মহাভারত মাখানো ছিল— দশরথের রাজপ্রাসাদ ছিল তাদের পাড়ার ফণি মুখুজ্যেদের ভাঙা দোতলা বাড়িটা—মাধবীকঙ্কণে পড়া একলিঙ্গের মন্দির ছিল ছিরে পুকুরের পশ্চিমদিকের সীমানার বড়ো বাঁশঝাড়টার তলায় বঙ্গবাসীতে পড়া জোয়ান অব আর্ক মেষপাল চরাইত নদীপারের দেয়াড়ের কাশবনের চরে, শিমুলগাছের ছায়ায়…তারপর বড়ো হইয়া কত নতুন স্থানে একে একে গেল, মনের ছবি ক্রমশ পরিবর্তিত হইতে লাগিল—ম্যাপ চিনিল, ভূগোল পড়িল, বড়ো হইয়া যে সব বই পড়িল তাদের ঘটনা নিশ্চিন্দিপুরের মাঠে, বনে, নদীর পথেঘাটে থাকে না কিন্তু এতকালের পরেও বাল্যের যে ছবিগুলি একবার অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল তা অপরিবর্তিত আছে—এতকাল পরেও যদি রামায়ণ মহাভারতের কোনও ঘটনা কল্পনা করে নিশ্চিন্দিপুরের সেই অস্পষ্ট, বিস্মৃতপ্রায় স্থানগুলিই তার রথীভূমি হইয়া দাঁড়ায়–অনেককাল পর সেদিন আর একবার পুরোনো বইয়ের দোকানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া মাধবীকঙ্কণ ও জীবনসন্ধ্যা পড়িতেছিল—কি অত।পাতায় পাতায় নিশ্চিন্দিপুর মাখানো, বাল্যের ছবি এখনও সেই অস্পষ্টভাবে-মনে-হওয়া জঙ্গলে-ভরা পোড়ো পুকুরটার পশ্চিম সীমানায় বাশঝাড়ের তলায়!…
এবার মাঝে মাঝে দু-একটি পূর্বপরিচিত বন্ধুর সঙ্গে অপুর দেখা হইতে লাগিল। প্রায়ই। কেহ উকিল, কেহ ডাক্তার জানকী মফঃস্বলের একটা গবর্নমেন্টের স্কুলের হেডমাস্টার, মন্মথ অ্যাটর্নির ব্যবসায়ে বেশ উপার্জন করে। দেবব্রত একবার ইতিমধ্যে সস্ত্রীক কলিকাতা আসিয়াছিল, স্ত্রীর পা সারিয়া গিয়াছে, দুটি মেয়ে হইয়াছে। চাকরিতে সে বেশ নাম করিয়াছে, তবে চেষ্টায় আছে কন্ট্রাক্টরি ব্যবসায় স্বাধীনভাবে আরম্ভ করিতে। দেওয়ানপুরের বাল্যবন্ধু সেই সমীর আজকাল ইনসিওরেন্সের বড়ো দালাল। সে চিরকাল পয়সা চিনিত, হিসাবী ছিল—আজকাল অবস্থা ফিরাইয়া ফেলিয়াছে। কষ্টদুঃখ করিতে করিতে একবারও সে ইহাদিগকে হিংসা করে না। তারপর এবার জানকীর সঙ্গে একদিন কলিকাতায় দেখা হইল। মোটা হইয়া গিয়াছে বেজায়, মনের তেজ নাই, গৃহস্থালির কথাবার্তা—অপুর মনে হইল সে যেন একটা বদ্ধ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করিয়া বসিযা আছে।
তাহার অ্যাটর্নি বন্ধু মন্মথ একদিন বলিল—ভাই, সকাল থেকে ব্রিফ নিয়ে বসি, সারাদিনের মধ্যে আর বিশ্রাম নেই—খেয়েই হাইকোর্ট, পাঁচটায় ফিরে একটা জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজারি করি ঘণ্টা-তিনেক–তারপর বাড়ি ফিরে আবার কাজ-খবরের কাগজখানা পড়বার সময় পাইনে, কিন্তু এত টাকা রোজগার করি, তবু মনে হয়, ছাত্রজীবনই ছিল ভালো। তখন কোন একটা জিনিস থেকে বেশি আনন্দ পেতুম—এখন মনে হয়, আই হ্যাভ লস্ট দি সস্ অফ লাইফ
অপু নিজের কথা ভাবিয়া দেখে। কই, এত বিরুদ্ধ ঘটনার ভিতর দিয়াও তাহার মনে আনন্দ-কেন নষ্ট হয় নাই? নষ্ট হয় তো নাই-ই, কেন তাহা দিনে দিনে এমন অদ্ভুত ধরনের উচ্ছ্বসিত প্রাচুর্যে বাড়িয়া চলিয়াছে? কেন পৃথিবীটা, পৃথিবী নয়—সারা বিশ্বটা, সারা নাক্ষত্রিক বিশ্বটা এক অপরুপ বঙে তাহার কাছে রঙিন? আর দিনে দিনে এ কি গহন গভীর বহস্য তাহাকে মুগ্ধ করিয়া প্রতি বিষয়ে অতি তীব্রভাবে সচেতন কবিযা দিতেছে? …
সে দেখিতে পায় তার ইতিহাস, তাব এই মনের আনন্দের প্রগতিব ইতিহাস, তাব ক্রমবর্ধমান চেতনাব ইতিহাস।
এই জগতেব পিছনে আর একটা যেন জগৎ আছে। এই দৃশ্যমান আকাশ, পাখির ডাক, এই সমস্ত সংসার-জীবন-যাত্রা—তারই ইঙ্গিত আনে মাত্ৰদূর দিগন্তে বহুদূর ওপাবে কোথায় যেন সে জগৎটা-পিঁয়াজের একটা খোব মধ্যে যেমন আব একটা খোসা, তার মধ্যে আব একটা খোসা, সেটাও তেমনি এই আকাশ, বাতাস, সংসারেব আববণে কোথায় যেন ঢাকা আছে, কোন্ জীবন পারের মনেব পারের দেশে। স্থির সন্ধ্যায় নির্জনে একা কোথাও বসিয়া ভাবিলেই সেই জগৎটা একটু একটু নজরে আসে।
সেই জগৎটার সঙ্গে যোগ-সেতু প্রথম স্থাপিত হয় তার বাল্যে—দিদি যখন মারা যায়। তারপর অনিল-মা—অপর্ণা—সর্বশেষে লীলা। দুস্তর অশ্রুর পারাবার সারাজীবন ধরিয়া পাড়ি দিয়া আসিয়া আজ যেন বহু দূরে সে দেশের তালীবনরেখা অস্পষ্ট নজরে আসে।
আজ গোলদিঘির বেঞ্চিখানায় বসিয়া তাই সে ভাবিয়া দেখিল, অনেক দিন আগে তার বন্ধু অনিল যে-কথা বলিয়াছিল, এ জেনাবেশনের হাত হইতে কাজের ভার লওয়া—আর সবাই তো লইয়াছে, তার সকল সহপাঠীই এখন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, দিকে দিকে জীবনের সকল কর্মক্ষেত্রে তারা নামিয়া পড়িয়াছে, কেবল ভবঘুরে হইয়াছে সে ও প্রাব। কিন্তু সত্য কথা সে বলিবে?…মন তার কি বলে?