অপু টাকাটা দিয়া দিল। বাহির হইতে যাইতেছে, বড়ো ছেলেটিকে তার মা যেন কি শিখাইয়া দিল, সে দরজার কাছে আসিয়া বলিল—ও কাকাবাবু, আমার দু-খানা ইস্কুলের বই এখনও কেনা হয় নি—কিনে দেবেন? বই না কিনলে মাস্টার মারবে—
হরেন ভানের সুরে বলিল–যা যা আবার বই—হ্যাঁ, ইস্কুলও যত–ফি বছর বই বদলাবে–যা এখন–
অপু তাহাকে বলিল—এখন তো আর কিছু হাতে নেই খোকা, পকেট একেবারে খালি।
হরেন অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সে চাষবাস করিবার জন্য উত্তরপাড়ায় জমি দেখিয়া আসিয়াছে, দুই হাজার টাকা হইলে হয়—অপূর্ব কি টাকাটা ধার দিতে পারিবে? না হয়, আধাআধি বখরা—খুব লাভের ব্যবসা।
প্রথম দিনের সাক্ষাতেই এ সব?
কেমন একটা অপ্রীতিকর মনোভাব লইয়া অপু বাসায় ফিরিল। শেষে কিনা জুয়ার দালালি? প্রথম যৌবনে ছিল চোর, আরও কত কি করিয়াছে, কে খোঁজ রাখে? এ আর ভালো হইল না!
দিন তিনেক পর একদিন সকালে হরেন আসিয়া হাজির অপুর বাসায়। নানা বাজে কথার পর উত্তরপাড়ার জমি লওয়ার কথা পাড়িল। টিউবওয়েল বসাইতে হইবে। কারণ জলের সুবিধা নাইঅপূর্ব কত টাকা দিতে পারে? উঠিবার সময় বলিল—ওহে, তুমি মানিককে কি বই কিনে দেবে বলেছিলে, আমায় বলছিল!
অপু ভাবিয়া দেখিল এরূপ কোন কথা মানিককে সে বলে নাই—যাহা হউক, না হয় দিয়া দিবে এখন। মানিককে বইয়ের দরুন টাকা হরেনের হাতে দিয়া দিল।
তাহার পর হইতে হরেনের যাতায়াত শুরু হইল একটু ঘন ঘন। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে ছেলে মানিকও আসিতে লাগিল। কখনও সে আসিয়া বলে, তাহারা বায়স্কোপ দেখিতে যাইবে, টাকা দিন কাকাবাবু। কখনও তাহার জুতা নাই, কখনও ছোট খোকার জামা নাইকখনও তাহার বড়ো দিদি, ছোট দিদির বায়না। ইহারা আসিলেই দু-তিন টাকার কমে অপুর পার পাইবার উপায় নাই। হরেনও নানা ছুতায় টাকা চায়, বাড়ি ভাড়া স্ত্রীর অসুখ।
একদিন কাজলের একটা সেলুলয়েডের ঘর-সাজানো জাপানী সামুরাই পুতুল খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। তার দিন-দুই আগে মানিকের সঙ্গে তার ছোট বোন টেপি আসিয়াছিল—অনেকক্ষণ পুতুলটা নাড়াচাড়া করিতেছিল, কাজল দেখিয়াছে। তারপর দিন দুই আর সেটার খোঁজ নাই, কাজল আজ দেখিল পুতুলটা নাই। ইহার দিন পনেরো পরে হরেনের বাসায় চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়া অপু দেখিল, কাজলের জাপানী পুতুলটা একেবারে সামনেই একটা হ্যারিকেন লণ্ঠনের পাশে বসানো। পাছে ইহারা লজ্জায় পড়ে তাই সেদিকটা পিছু ফিরিয়া বসিল ও যতক্ষণ রহিল, লণ্ঠনটার দিকে আদৌ চাহিল না। ভাবিল-যাক গে, খুকি লোভ সামলাতে না পেরে এনেছে, খোকাকে আর একটা কিনে দেবো!
উঠিয়া আসিবার সময় মানিক বলিল—মা বললেন, তোর কাকাবাবুকে বল—একদিন আমাদের কালীঘাট দেখিয়ে আনতে সামনের রবিবার চলুন কাকাবাবু, আমাদের ছুটি আছে, আমিও যাব।
অপুর বেশ কিছু খরচ হইল রবিবারে। ট্যাক্সিভাড়া, জলখাবার, ছেলেপিলেদের খেলনা ক্রয়, এমন কি বড় মেয়েটির একখানা কাপড় পর্যন্ত। কাজলও গিয়াছিল, সে এই প্রথম কালীঘাট দেখিয়া খুব খুশি।
সেদিন নিজের অলক্ষিতে অপুর মনে হইল, তাহার কবিরাজ বন্ধুটি ও তাহার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কথা তাদের প্রথম জীবনের সেই দারিদ্র—সেই পরিশ্রম কখনও বিশেষ কিছু তো চাহে নাই কোনদিন–বরং কিছু দিতে গেলে ক্ষুন্ন হইত। কিন্তু আন্তরিক স্নেহটুকু ছিল তাহার উপর। এখনও ভাবিলে অপুর মন উদাস হইয়া পড়ে।
বাড়ি ফিরিয়া দেখিল, একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছোকরা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। দেখিতে শুনিতে বেশ, সুন্দর চোখ-মুখ, একটু লাজুক, কথা বলিতে গেলে মুখ রাঙা হইয়া যায়।
অপু তাহাকে চিনিল-চাঁপদানির পূর্ণ দিঘড়ীর ছেলে রসিকলাল—যাহাকে সে টাইফয়েড হইতে বাঁচাইয়াছিল। অপু বলিল-রসিক, তুমি আমার বাসা জানলে কি করে?
–আপনার লেখা বেরুচ্ছে ‘বিভাবরী’ কাগজে-তাদের অফিস থেকে নিয়েছি—
–তারপর, অনেককাল পর দেখা—কি খবর বলো।
—শুনুন, দিদিকে মনে আছে তো? দিদি আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে-বলে দিয়েচে যদি কলকাতায় যাস, তবে মাস্টার মশায়ের সঙ্গে দেখা করিস। আপনার কথা বড় বলে, আপনি একবার আসুন না চাপদানিতে।
-পটেশ্বরী? সে এখনও মনে করে রেখেছে আমার কথা?
রসিক সুর নিচু করিয়া বলিল—আপনার কথা বলে না এমন দিন নেই—আপনি চলে এসেছেন আট-দশ বছর হল—এই আট-দশ বছরের মধ্যে আপনার কথা বলে না—এমন একটা দিনও বোধ হয় যায় নি। আপনি কি কি খেতে ভালোবাসতেন—সে-সব দিদির এখনও মুখস্থ। কলকাতায় এলেই আমায় বলে, মাস্টারমশায়ের খোঁজ করিস না রে? আমি কোথায় জানব আপনার খোঁজ-কলকাতা শহর কি চাপদানি? দিদি তা বোঝে না। তাই এবার বিভাবরীতে আপনার লেখা–
—পটেশ্বরী কেমন আছে? আজকাল আর সে-সব শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার
–শাশুড়ি মারা গিয়েছে, আজকাল কোন অত্যাচার নেই, দু-তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে, সে-ই আজকাল গিন্নি, তবে সংসারের বড়ো কষ্ট। আমাকে বলে দেয় বোতলের চাটনি কিনতে দশ আনা দাম–আমি কোথা থেকে পাব—তাই একটা ছোট বোতল আজ এই দেখুন কিনে নিয়ে যাচ্ছি ছ-আনায়। টেপারির আচার। ভালো না?
–এক কাজ করো। চলো আমি তোমাকে আচার কিনে দিচ্ছি, আমের আচার ভালোবাসে? চলো দেশী চাটনি কিনি। ভিনিগার দেওয়া বিলিতি চাটনি হয়তো পছন্দ করবে না।
–আপনি কবে আসবেন? আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ আপনাকে নিয়ে যাই নি শুনলে দিদি আমাকে বাড়িতে তিঞ্ছতে দেবে না কিন্তু, আজই আসুন না?