প্রথমটা তারা খাইতে রাজি হয় না, অনেক করিয়া অপু তাহাদের লজ্জা ভাঙিল। অপু বলিল-ভালো সিরাপ তোমার আছে? থাকে তো দাও, আমি দাম দোব। কোন জায়গা থেকে এনে দিতে পারো না?
বোতলে যাহা আছে তাহার অপেক্ষা ভালো সিরাপ এ অঞ্চলে নাকি কুত্রাপি মেলা সম্ভব নয়। অবশেষে সেই শরবই এক এক বড়ো গ্লাস দুই ভাই-বোন মহাতৃপ্তি ও আনন্দের সহিত খাইয়া ফেলিল, সবুজ বোতলের সেই টক চিনির রসই।
অপু তাহাদের বিস্কুট ও এক পয়সা মোড়কের বাজে চকলেট কিনিয়া দিল—দোকানটাতে ভালো কিছু যদি পাওয়া যায় ছাই। তবুও অপুর মনে হইল পয়সা তার সার্থক হইয়াছে আজ।
বাসায় ফিরিয়া তাহার মনে হইল বড়ো সাহিত্যের প্রেরণার মূলে এই মানববেদনা। ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রজাস্বত্ব আইন, সার্যনীতি, জার-শাসিত রাশিয়ার সাইবেরিয়া, শীত, অত্যাচার, কুসংস্কার, দারিদ্র—গোগোল, ডস্টয়ভস্কি, গোর্কি, টলস্টয় ও শেকভের সাহিত্য সম্ভব করিয়াছে। সে বেশ কল্পনা করিতে পারে, দাস-ব্যবসায়ের দুর্দিনে, আফ্রিকার এক মরু-বেষ্টিত পল্লীকুটির হইতে কোমল বয়স্ক এক নিগ্রো বালক পিতামাতার স্নেহকোল হইতে নিষ্ঠুরভাবে বিচ্যুত হইয়া বহু দূর বিদেশের দাসের হাটে ক্রীতদাসরূপে বিক্রিত হইল, বহুকাল আর সে বাপ-মাকে দেখিল না, ভাইবোনেদের দেখিল না—দেশে দেশে তাহার অভিনব জীবনধারার দৈন্য, অত্যাচার ও গোপন অশ্রুজলের কাহিনী, তাহার জীবনের সে অপূর্ব ভাবানুভূতির অভিজ্ঞতা সে যদি লিখিয়া রাখিয়া যাইতে পারিত! আফ্রিকার নীরব নৈশ আকাশ তাহাকে প্রেরণা দিত, তাম্রবর্ণ মরুদিগন্তের স্বপ্নমায়া তাহার চোখে অঞ্জন মাখাইয়া দিত; কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের দুর্ভাগ্য, তাহারা নীরবে অত্যাচার সহ্য করিয়া বিশ্ব হইতে বিদায় লইল।
দিন দুই পরে একদিন সন্ধ্যার পর গড়ের মাঠ হইতে একা বেড়াইয়া ফিরিবার মুখে হোয়াটিওয়ে লেড়লর দোকানের সামনে একটুখানি দাঁড়াইয়াছে—একজন আধাবয়সি লোক কাছে আসিয়া বলিল-বাবু, প্রেমারা খেলবেন? খুব ভালো জায়গা। আমি নিয়ে যাব, এখান থেকে পাঁচ মিনিট। ভদ্র জায়গা, কোন হাঙ্গামায় পড়তে হবে না। আসবেন?
অপু বিস্মিতমুখে লোকটার মুখের দিকে চাহিল। আধময়লা কাপড় পরনে, খোঁচা খোঁচা কড়া দাড়ি-গোঁফ, ময়লা দেশী টুইলের শার্ট, কজির বোতাম নাই-পানে ঠোঁট দুটো কালো। দেখিয়াই চিনিল—সেই ছাত্রজীবনের পরিচিত বন্ধু হরেন—সেই যে ছেলেটি একবার তাহাদের কলেজ ইতে বই চুরি করিয়া পলাইতে গিয়া ধরা পড়ে। বহুকাল আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই—অপু লেখাপড়া হাড়িয়া দিবার পর আর কখনও নয়। লোকটাও অপুকে চিনি, থতমত খাইয়া গেল। অপুও বিস্মিত হইয়াছিল—এসব ব্যাপারের অভিজ্ঞতা তাহার নাই—জীবনে কখনও না—তবুও সে বুঝিয়াছিল তাহার এই ছাত্রজীবনের বন্ধুটি কোন পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে কিছু উত্তর করিবার পুর্বে হরেন আসিয়া তাহার হাত দুটি ধরিল—বলিল, মাপ করো ভাই, আগে টের পাই নি। বহুকাল পরে দেখা-থাক কোথায়?
অপু বলিল—তুমি থাক কোথায়—এখানেই আছ—কত দিন?…
–এই নিকটেই। তালতলা লেন–আসবে…অনেক কথা আছে—
—আজ আর হবে না; আসছে সোমবার পাঁচটার সময় যাব। নম্বরটা লিখে নিই।
—সে হবে না ভাই—তুমি আর আসবে না—তোমার দেখা আর পাবার ভরসা রাখি নে। আজই চলে।
অতি অপরিচ্ছন্ন বাসা। একটি মাত্র ছোট ঘর।
অপু ঘরে ঢুকিতেই একটা কেমন ভ্যাপসা গন্ধ তাহার নাকে গেল। ছোট্ট ঘর, জিনিসপত্রে ভর্তি, মেজেতে বিছানা-পাড়া, তাহারই একপাশে হরেন অপুর বসিবার জায়গা করিয়া দিল। ময়লা চাদর, ময়লা কথা, ময়লা বালিশ, ময়লা কাপড়, ঘেঁড়া মাদুর কলাই-করা গ্লাস, থালা, কালিপড়া হারিকেন লণ্ঠন, কাঁথার আড়াল হইতে তিন-চাবটি শীর্ণ কালো কালো ছোট হাত পা বাহির হইয়া আছে একটি সাত-আট বছরের মেয়ে ওদিকের দালানে দুয়ারের চৌকাঠের উপর বসিয়া। দালানের ওপাশটা রান্নাঘর—হরেনের স্ত্রী সম্ভবত রাঁধিতেছে।
হরেন মেয়েটিকে বলিল—ওরে টেপি, তামাক সাজ তো–
অপু বলিল—ছোট ছেলেমেয়েকে দিয়ে তামাক সাজাও কেন?…নিজে সাজো–ও শিক্ষা ভালো নয়–
হরেন স্ত্রীর উদ্দেশে চিৎকার করিয়া বলিল—কোথায় রইলে গো, এদিকে এসো, ইনি আমার কলেজ আমলের সকলের চেয়ে বড়ো বন্ধু, এত বড়ো বন্ধু, আর কেউ ছিল না–এঁর কাছে লজ্জা করতে হবে না—একটু চা-টা খাওয়াও—এসো এদিকে।
তারপর হবেন নিজের কাহিনী পাড়িল। কলেজ ছাড়িয়াই বিবাহ হয—তারপর এই দুঃখদুর্দশাবড়ো জড়াইয়া পড়িয়াছে—বিশেষত এই সব লেণ্ডি-গেণ্ডি। কত বকম করিযা দেখিয়াছে— কিছুতেই কিছু হয় না। স্কুলমাস্টারি, দোকান, চালানী ব্যবসা, ফটোগ্রাফির কাজ, কিছুই বাকি রাখে নাই। আজকাল যাহা করে তা তো অপু দেখিয়াছে! বাসায় কেহ জানে না—উপায় কি!—এতগুলি মুখে অন্ন তো—এই বাজার ইত্যাদি।
হরেনের কথাবার্তার ধরন অপুর ভালো লাগিল না। চোখেমুখে কেমন যেন একটা—ঠিক বোঝানো যায় না –অপুর মনে হইল হরেন এই সব নীচ ব্যবসায়ে পোক্ত হইয়া গিয়াছে।
হরেনের স্ত্রীকে দেখিয়া অপুর মন সহানুভূতিতে আর্দ্র হইয়া উঠিল। কালো, শীর্ণ চেহাবা, হাতে গাছকতক কাচের চুড়ি। মাথায় সামনে দিকে চুল উঠিয়া যাইতেছে, হাতে কাপড়ে বাটনার হলুদমাখা! সে এমন আনন্দ ও ক্ষিপ্রতার সহিত চা আনিয়া দিল যে, সে মনে করে যেন এতদিনে স্বামীর পরমহিতৈষী বন্ধুর সাক্ষাৎ যখন পাওয়া গিয়াছে—দুঃখ বুঝি ঘুচিল। উঠিবার সময় হরেন বলিলভাই, বাড়িভাড়া কাল না দিলে অপমান হব—পাঁচটা টাকা থাকে তো দাও তো?