পত্র পাঠ শেষ করিয়া সে খানিকক্ষণ কি ভাবিল, ছেলেকে বলিল, আচ্ছা থোকা, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যদি চলে যাই, তুই থাকতে পারবি নে? যদি তোকে মামার বাড়ি রেখে যাই?
কাজল কাদ-কাদ মুখে বলিল, হ্যাঁ, তাই যাবে বইকি! তুমি ভারি দেরি করো, কাশীতে বলে গেলে তিন দিন হবে, কদিন পরে এলে? না বাবা—
অপু ভাবিল—অবোধ শিশু! এ কি কাশী? এ বহুদুর, দিনের কথা কি এখানে ওঠে?+-থাক, কোথায় যাইবে সে? কাহার কাছে রাখিয়া যাইবে খোকাকে? অসম্ভব।
কাজল ঘুমাইয়া পড়িলে ছাদে উঠিয়া সে অনেকক্ষণ একা বসিয়া রহিল।
দূরে বাড়িটার মাথায় সার্কুলার রোডের দিকে ভাঙা চাদ উঠিতেছে, রাত্রি বারোটার বেশি–নিচে একটা মোটর লরি ঘ ঘন্স আওয়াজ করিতেছে। এই রকম সময়ে এই রকম ভাঙা চাদ উঠিত দুরে জঙ্গলের মাথায় পাহাড়ের একটা জায়গায়, যেখানে উটের পিঠের মতো ফুলিয়া উঠিয়াই পরে বসিয়া গিয়া একটা খাজের সৃষ্টি করিয়াছে—সেই খাঁজটার কাছে, পাহাড়ি ঢালুতে বাদাম গাছের বনে দিনমানে পাকা পাতায় বনশীর্ষ যেখানে রক্তাভ দেখায়। এতক্ষণে বন-মোরগেরা ডাকিয়া উঠিত, কক্ কক্ কক্—
সে মনে মনে কল্পনা করিবার চেষ্টা করিল, সার্কুলার রোড নাই, বাড়ি-ঘর নাই, মোটর লরির আওয়াজ নাই, ব্রিজের আজ্ঞা নাই, লিলি পন্ড নাই, তার ছোট খড়ের বাংলো ঘরখানায় রামচরিত মিশ্র মেজেতে ঘুমাইতেছে, সামনে পিছনে ঘন অরণ্যভূমি, নির্জন নিস্তব্ধ, আধ-অন্ধকার রাত্রি। ক্রোশের পর ক্রোশ যাও, শুধু উঁচু-নিচু ডাঙা, শুকনা ঘাসের বন, সাজা ও আবলুসের বন, শালবন, পাহাড়ি চামেলি ও লোহিয়ার বন-বনফুলের অফুরন্ত জঙ্গল। সঙ্গে সঙ্গে মনে আসিল সেই মুক্তি, সেই রহস্য, সে সব অনুভূতি, ঘোড়ার পিঠে মাঠের পর মাঠ উদ্দাম গতিতে ছুটিয়া চলা, সেই দৃঢ়পৌরুষ জীবন, আকাশের সঙ্গে, ছায়াপথের সঙ্গে, নক্ষত্র-জগতের সঙ্গে প্রতি সন্ধ্যায় প্রতি রাত্রে যে অপুর্ব মানসিক সম্পর্ক।
এ কি জীবন সে যাপন করিতেছে এখানে। প্রতিদিন একই রকম একঘেয়ে নীরস, বৈচিত্র্যহীন—আজও যা, কালও তা। অর্থহীন কোলাহলে ও সার্থকতাহীন ব্রিজের আড্ডার আবহাওয়ায়, টাকা রোজগারের মৃগতৃষ্ণিকায় সুব্ধ জীবননদীর স্তব্ধ, সহজ সাবলীল ধারা যে দিনে দিনে শুকাইয়া আসিতেছে, এ কি সে বুঝিয়াও বুঝিতেছে না?
ঘুমের ঘোরে কাজল বিছানাব মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাকে এক পাশে সরাইয়া শোয়াইল। একেই তো সুন্দর, তার উপর কি যে সুন্দর দেখাইতেছে খোকাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।
কাশী হইতে ফিরিবার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অপু বিভাববী ও বঙ্গ-সুহৃৎ দুখানা পত্রিকার তরফ হইতে উপন্যাস লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়াছিল। দুখানাই প্রসিদ্ধ মাসিক পত্র, দুখানারই গ্রাহক সারা বাংলা জুড়িয়া এবং পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি আছে, সর্বত্র। বিভাবরী তাহাকে সম্প্রতি আগাম কিছু টাকা দিল—–বঙ্গসুহৃৎ-এর নিজেদের বড়ো প্রেস আছে—তাহারা নিজের খরচে অপুর একখানা ছোট গল্পের বই ছাপাইতে রাজি হইল। অপুর বইখানির বিক্রয়ও হঠাৎ বাড়িয়া গেল, আগে যে-সব দোকানে তাহাকে পুঁছিতও না—সে-সব দোকান হইতে বই চাহিয়া পাঠাইতে লাগিল। এই সময়ে একটি বিখ্যাত পুস্তক-প্রকাশক ফার্মের নিকট হইতে একখানা পত্র পাইল, অপু যেন একবার গিয়া দেখা করে।
অপু বৈকালের দিকে দোকানে গেল। তাহারা বইখানির দ্বিতীয় সংস্করণ নিজেদের খরচে ছাপাইতে ইচ্ছুক-অপু কি চায়? অপু ভাবিয়া দেখিল। প্রথম সংস্করণ হু-হু কাটিতেছে—অপর্ণার গহনা বিক্রয় করিয়া বই ছাপাইয়াছিল, লাভটা তার সবই নিজের। ইহাদের দিলে লাভ কমিয়া যাইবে বটে, কিন্তু দোকানে দোকানে ছুটাছুটি, তাগাদা—এসব হাঙ্গামাও কমিবে। তা ছাড়া নগদ টাকার মোহ আছে, সাত পাঁচ ভাবিয়া সে রাজি হইল। ফার্মের কর্তা তখনই একটা লেখাপড়া করিয়া লইলেন— আপাতত ছশো টাকায় কথাবার্তা মিটিল, শ-দুই সে নগদ পাইল।
দুশো টাকা খুচরা ও নোটে। এক গাদা টাকা! হাতে ধবে না। কি করা যায় এত টাকায়? পুরানো দিন হইলে সে ট্যাক্সি করিয়া খানিকটা বেড়াইত, রেস্টুরেন্টে খাইত, বায়োস্কোপ দেখিত। কিন্তু আজকাল আগেই খোকার কথা মনে হয়। খোকাকে কি আনন্দ দেওয়া যায় এ টাকায়? মনে হয় লীলার কথা। লীলা কত আনন্দ করিত আজ!
একটা ছোট গলি দিয়া যাইতে যাইতে একটা শরবৎ-এর দোকান। দোকানটাতে পান বিড়ি বিস্কুট বিক্রি হয়, আবার গোটা দুই তিন সিরাপের বোতলও রহিয়াছে। দিনটা খুব গরম, অপু শরবৎ খাওয়ার জন্য দোকানটাতে দাঁড়াইল। অপুর একটু পরেই দুটি ছেলেমেয়ে সেখানে কি কিনিতে আসিল। গলিরই কোন গরিব ভাড়াটে গৃহস্থ ঘরের হোট ছেলে মেয়ে-মেয়েটির বছর সাত, ছেলেটি একটু বড়ো। মেয়েটি আঙুল দিয়া সিরাপের বোতল দেখাইয়া বলিল—ওই দ্যাখ দাদা সবুজ-বেশ ভালো, না? ছেলেটি বলিল—সব মিশিয়ে দ্যায়। বরফ আছে, ওই যে
—ক পয়সা নেয়?
—চার পয়সা।
অপুর জন্য দোকানী শরবৎ মিশাইতেছে, বরফ ভাঙিতেছে, ছেলেমেয়ে দুটি মুগ্ধনেত্রে দেখিতে লাগিল। মেয়েটি অপুর দিকে চাহিয়া বলিল—আপনাকে ওই সবুজ বোতল থেকে দেবে, না?
যেন সবুজ বোতলের মধ্যে শচীদেবীর পায়েস পোরা আছে।
অপুর মন করুণা হইল। ভাবিলএরা বোধ হয় কখনও কিছু দেখে নি—এই রং করা টক চিনির রসকে কি ভাবছে, ভালো সিরাপ কি জানে না। বলিল-খুকি, খোকা শরবৎ খাবে? খাও না–ওদের দু গ্লাস শরবৎ দাও তো—