এতদিন সে বাড়িটা আর নাই…কতকাল আগে ভাঙিয়া চুরিয়া ইট-কাঠ স্তুপাকার হইয়া আছে—তাহাও হয়তো মাটির তলায় চাপা পড়িতে চলিল—সে শৈশবের জানালাটার কোনও চিহ্ন নাই দীর্ঘদিনের শেষে সোনালি রোদ যখন বনগাছের ছায়া দীর্ঘতর করিয়া তোলে, ফিঙে-দোয়েল ডাক শুরু করে—তখন আর কোনও মুগ্ধ শিশু জানালার ধারে বসিয়া থাকে না-হাত তুলিয়া অনুযোগের সুরে বলে না—আজ রাতে যদি মা ঘরে জল পড়ে, কাল কিন্তু ঠিক রানুদিদিদের বাড়ি গিয়ে শোবো-রোজ রোজ রাত জাগতে পারি নে বলে দিচ্ছি।
অপুর একটা কথা মনে হইয়া হাসি পাইল।
গ্রাম ছাড়িয়া আসিবার বছরখানেক আগে অপু একরাশ কড়ি পাইয়াছিল। তাহার বাবা শিষ্যবাড়ি হইতে এগুলি আনেন। এত কড়ি কখনও অপু ছেলেবেলায় একসঙ্গে দেখে নাই। তাহার মনে হইল সে হঠাৎ অত্যন্ত বড়োলোক হইয়া গিয়াছে—কড়ি খেলায় সে যতই হারিয়া যাক, তাহার অফুরন্ত ঐশ্বর্যের শেষ হইবে না। একটা গোল বিস্কুটের ঠোঙায় কড়ির রাশি রাখিয়া দিয়াছিল। সে ঠোঙাটা আবার তোলা থাকিত তাদের বনের ধারের দিকের ঘরটায় উঁচু কুলুঙ্গিটাতে।
তারপর নানা গোলমালে খেলাধুলায় অপুর উৎসাহ গেল কমিয়া, তার পরই গ্রাম ছাড়িয়া উঠিয়া আসিবার কথা হইতে লাগিল। অপু আর একদিনও ঠোঙার কড়িগুলি লইয়া খেলা করিল না, এমন কি দেশ ছাড়িয়া চলিয়া আসিবার সময়েও গোলমালে, ব্যস্ততায়, প্রথম দূর বিদেশে রওনা হইবার উত্তেজনার মুহূর্তে সেটার কথা মনেও উঠে নাই। অত সাধের কড়িভরা ঠোঙাটা সেই কড়িকাঠের নিচেকার বড়ো কুলুঙ্গিটাতেই রহিয়া গিয়াছিল।
তারপর অনেককাল পরে সে কথা অপুর মনে হয় আবার। তখন অপর্ণা মারা গিয়াছে। একদিন অন্যমনস্ক ভাবে ইডেন গার্ডেনের কেয়াঝোপে বসিয়া ছিল, গঙ্গার ও-পারের দিকে সূর্যাস্ত দেখিতে দেখিতে কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে।
আজও মনে হইল।
কড়ির কৌটো! একবার সে মনে মনে হাসিল…বহুকাল আগে নিশ্চিহ্ন হইয়া লুপ্ত হইয়া যাওয়া ছেলেবেলার বাড়ির উত্তর দিকের ঘরের কুলুঙ্গিতে বসানো সেই টিনের ঠোঙাটা!দূরে সেটা যেন শূন্যে কোথায় এখনও ঝুলিতেছে, তাহার শৈশবজীবনের প্রতীকস্বরূপ…অস্পষ্ট, অবাস্তব, স্বপ্নময় ঠোঙাটা সে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে, পয়সায় চার গণ্ডা করিয়া মাকড়সার ডিমের মতো সেই যে ছোট ছোট বিস্কুট তারই ঠোঙাটি—উপরে একটা বিবর্ণপ্রায় হাঁ-করা রাক্ষসের মুখের ছবি…দূরে কোন্ কুলুঙ্গিতে বসানো আছে…তার পিছনে বাঁশবন, শিমুলবন, তার পিছনে সোনাডাঙার মাঠ, ঘুঘুর ডাক…তাদেরও পিছনে তেইশ বছর আগেকার অপূর্ব মায়ামাখানো নিঝুম চৈত্র-দুপুরের রৌদ্রভরা নীলাকাশ…
২৩. চৈত্র মাসের প্রথমে
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
চৈত্র মাসের প্রথমে একটা বড়ো পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত হইয়া গেল। খুব বড়ো গাড়িবারান্দা, সামনের লনে ছোট ছোট টেবিল ও চেয়ার পাতা, খানিকটা জায়গা সামিয়ানা টাঙানো। নিমন্ত্রিত পুরুষ মহিলাগণ যাহারা যেখানে ইচ্ছা বেড়াইতেছেন। একটা মার্বেলের বড়ো চৌবাচ্চায় গোটাকতক কুমুদ ফুল, ঠিক মাঝখানে একটা মার্বেলের ফোয়ারা—গৃহকর্মী তাহাকে লইয়া গিয়া জায়গাটা দেখাইলেন, সেটা নাকি তাদের লিলি পন্ড। জয়পুর হইতে ফোয়ারাটা তৈয়ারি করাইয়া আনিতে কত খরচ পড়িয়াছে, তাহাও জানাইলেন।
পার্টির সকল আমোদ-প্রমোদের মধ্যে একটি মেয়ের কণ্ঠসংগীত সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক মনে হইল। ব্রিজের টেবিলে সে যোগ দিতে পারিল না, কারণ ব্রিজ-খেলা সে জানে না, গান শেষ হইলে খানিকটা বসিয়া বসিয়া খেলাটা দেখিল। চা, কেক, স্যান্ডউইচ, সন্দেশ, রসগোল্লা, গল্প-গুজব, আবার গান! ফিরিবার সময় মনটা খুব খুশি ছিল। ভাবিল—এদের পার্টিতে নেমন্তন্ন পেয়ে আসা একটা ভাগ্যের কথা। আমি লিখে নাম করেছি, তাই আমার হল। যার-তার হোক দিকি? কেমন কাটল সন্ধেটা। আহা, খোকাকে আনলে হত, ঘুমিয়ে পড়বে এই ভয়ে আনতে সাহস হল না যে-খান-দুই কেক খোকার জন্য চুপিচুপি কাগজে জড়াইয়া পকেটে পুরিয়া রাখিয়াছিল, খুলিয়া দেখিল সেগুলি ঠিক আছে কি না।
খোকা ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিয়া উঠাইতে গিয়া বলিল, ও খোকা, খোকা, ওঠ, খুব ঘুমুচ্ছিস যে—হি-হি-ওঠ রে।
কাজলের ঘুম ভাঙিয়া গেল। যখনই সে বোঝে বাবা আদব কবিতেছে, মুখে কেমন ধবনের মধুর দুষ্টামির হাসি হাসিয়া ঘাড় কাত করিয়া কেমন এক অদ্ভুত ভঙ্গি করিয়া আদরের প্রতীক্ষায় থাকে, আর এত আদর খাইতেও পারে!
অপু বলিল, শোন্ খোকা গল্প করি,—ঘুমুসনে–
কাজল হাসিমুখে বলে, বলল দিকি বাবা একটা অর্থ?
হাত কন্ কন্ মানিকতা, এ ধন তুমি পেলে কোথা,
রাজাব ভাণ্ডারে নেই, বেনের দোকানে নেই—
অপু মনে মনে ভাবে-খোকা, তুই-তুই আমার সেই বাবা। ছেলেবেলায় চলে গিয়েছিলে, তখন তো কিছু বুঝি নি, বুঝতামও না—শিশু ছিলাম! তাই আবার আমার কোলে আদর কাড়াতে এসেছ বুঝি? মুখে বলে, কি জানি, জাতি বুঝি?
—আহা-হা, আঁতি কি আব দোকানে পাওয়া যায় না! তুমি বাবা কিছু জানো না—
–ভালো কথা, কেক এনেছি, দ্যাখ, বড়োলোকের বাড়ির কেক, ওঠ—
–বাবা তোমার নামে একখানা চিঠি এসেছে, ওই বইখানা তোলে তো।…
আর্টিস্ট বন্ধুটির পত্র। বন্ধু লিখিয়াছে,—সমুদ্রপারের বৃহত্তর ভারতবর্ষ শুধু কুলি আমদানির সার্থকতা ঘোষণা করিয়া নীরব থাকিয়া যাইবে? তোমাদের মতো আর্টিস্ট লোকের এখানে আসার যে নিতান্ত দরকার। চোখ থাকিয়াও নাই শতকরা নিরানব্বই জনের, তাই চক্ষুষ্মন মানুষদেব একবার এসব স্থানে আসিতে বলি। পত্রপাঠ এসো, ফিজিতে মিশনারীরা স্কুল খুলিতেছে, হিন্দি জানা ভারতীয় শিক্ষক চায়, দিনকতক মাস্টারি তো করো, তারপর একটা কিছু ঠিক হইয়া যাইবে, কারণ চিরদিন মাস্টারি করিবার মতো শান্ত ধাত তোমার নয়, তা জানি। আসিতে বিলম্ব করিয়ো না।