আবার লীলা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
অপু বলিল, ঠিক বলেছ লীলাদি, আমারও গাঁয়ের কথা এত মনে পড়ে! সত্যিই, কি মধুমাখানো ছিল, তাই এখন ভাবি।
লীলা বলিল, পদ্মপাতায় খাবার খাস নি কতদিন বল দিকি? এসব দেশে শালপাতায় খাবার খেতে খেতে পদ্মপাতার কথা ভুলেই গিইছি, না? আবার এক একদিন এক একটা দোকানে কাগজে খাবার দেয়। সেদিন আমার মেজ ছেলে এনেছে, আমি বলি দূর দূর, ফেলে দিয়ে আয়, কাগজে আবার মিষ্টি খাবার কেউ দেয় আমাদের দেশে?
অপুর সারা দেহ স্মৃতির পুলকে যেন অবশ হইয়া গেল। লীলাদি মেয়েমানুষ কিনা, এত খুঁটিনাটি জিনিসও মনে রাখে। ঠিকই বটে, সেও পদ্মের পাতায় কতকাল খাবার খায় মাই, ভুলিয়াই গিয়াছিল কথাটা। তাহাদের দেশে বড়ো বড়ো বিল, পদ্মপাতা সস্তা, শালপাতার রেওয়াজ ছিল না। নিমন্ত্রণ বাড়িতেও পদ্মপাতাতে ব্রাহ্মণভোজন হইত, লীলাদির কথায় আজ আবার সব মনে পড়িয়া গেল।
লীলা চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—তুই কতদিন যাস নি সেখানে অপু? তেইশ বছর? কেন, কেন? আমি না হয় মেয়েমানুষ—তুই তো ইচ্ছে করলেই যেতে
–তা নয় লীলাদি, প্রথমে ভাবতুম বড়ো হয়ে যখন রোজগার করব মাকে নিয়ে আবার নিশ্চিন্দিপুরের ভিটেতে গিয়ে বাস করব, মার বড় সাধ ছিল। মা মারা যাওয়ার পরেও ভেবেছিলুম, কিন্তু তার পরে–ইয়ে—
স্ত্রীবিয়োগের কথাটা অপু বয়োজ্যেষ্ঠা লীলাদির নিকট প্রথমটা তুলিতে পারিল না। পরে বলিল। লীলা বলিল, বৌ কতদিন বেঁচেছিলেন?
অপু লাজুক সুরে বলিল–বছর চারেক–
–তা এ তোমার অন্যায় কাজ ভাই-তোমার এ বয়সে বিয়ে করবে না কেন?…তোমাকে তো এতটুকু দেখেছি, এখনও বেশ মনে হচ্ছে, ছোট্ট পাতলা টুকটুকে ছেলেটি—একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে আমাদের ঘাটের পথের বাঁশতলাটায় বেড়িয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছ কালকের কথা যেন সব, না, ও কি, ছিঃ—বিয়ে করো ভাই। খোকাকে কলকাতায় রেখে এলে কেন—দেখতাম একবারটি।
লীলাও উঠিতে দেয় না—অপুও উঠিতে চায় না। লীলার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিল— ছেলেমেয়েগুলিকে আদর করিল। উঠিবার সময় লীলা বলিল—কাল আসিস অপু, নেমন্তন্ন রইল,এখানে দুপুরে খাবি।
পরদিন নেমন্তন্ন রাখিতে গিয়া কিন্তু অপু লীলাদির পরাধীনতা মর্মে মর্মে বুঝিল—সকাল হইতে সমুদয় সংসারের রান্নার ভার একা লীলাদির উপর। কৈশোরে লীলাদি দেখিতে ছিল খুব ভালো—এখন কিন্তু সে লাবণ্যের কিছুই অবশিষ্ট নাই—চুল দু-চার গাছা এরই মধ্যে পাকিয়াছে, শীর্ণ মুখ, শিরা-বাহির-হওয়া হাত, আধময়লা শাড়ি পরনে, রাঁধিবার আলাদা ঘরদোর নাই, ছোট্ট দালানের অর্ধেকটা দরমার বেড়া দিয়া ঘেরা, তারই ও-ধারে রান্না হয়। লীলাদি সমস্ত রান্না সারিয়া তার জন্য মাছের ডিমের বড়া ভাজিতে বসিল, একবার কড়াখানা উনুন হইতে নামায়, আবার তোলে, আবার নামায়, আবার ভাজে! আগুনের তাপে মুখ তার রাঙা দেখাইতেছিল—অপু ভাবিল কেন এ কষ্ট করছে লীলাদি, আহা রোজ রোজ ওর এই কষ্ট, তার ওপর আমার জন্যে আর কেন কষ্ট কর?
বিদায় লইবার সময় লীলা বলিল—কিছুই করতে পারলুম না ভাই—এলি যদি এতকাল পরে, কি করি বল, পরের ঘরকন্না, পরের সংসার, মাথা নিচু করে থাকা, উদয়াস্ত খাটুনিটা খেলি তো? কি আর করি, তবুও একটা ধরে আছি। মেয়েটা বড়ো হয়ে উঠল, বিয়ে তো দিতে হবে? ওই বঠাকুর ছাড়া আর ভরসা নেই। সন্ধেবেলাটা বেশ ভালো লাগে—দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধের সময় বেশ কথা হয়, পাচালী হয়, গান হয়–বেশ লাগে। দেখিস নি?…আসিস না আজ ওবেলা—বেশ জায়গা, আসিস, দেখিস এখন। এসো, এসো, কল্যাণ হোক। তারপর সে আবার কাঁদিয়া ফেলিল-বলিল—তোদের দেখলে যে কত কথা মনে পড়ে কি সব দিন ছিল–
এবার অপু অতিকষ্টে চোখের জল চাপিল।
আর একটি কর্তব্য আছে তাহার কাশীতে-লীলার মায়ের সঙ্গে দেখা করা। বাঙালিটোলার নারদ ঘাটে তাঁদের নিজেদের বাড়ি আছে—জিয়া বাড়ি বাহির করিল। মেজ-বৌরানী অপুকে দেখিয়া খুব আনন্দ প্রকাশ করিলেন। চোখের জল ফেলিলেন।
কথাবার্তা চলিতেছে এমন সময় ঘরে একটি ছোট মেয়ে ঢুকিল-বয়স ছয়সাত হইবে, ফ্রক পরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল—অপু তাহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারিল লীলার মেয়ে। কি সুন্দর দেখিতে! এত সুন্দরও মানুষ হয়? স্নেহে, স্মৃতিতে, বেদনায় অপুর চোখে জল আসিলসে ডাক দিলশোনো খুকি, মা, শোনো তো।
খুকি হাসিয়া পলাইতেছিল, মেজ-বৌরানী ডাকিয়া আনিযা কাছে বসাইয়া দিলেন। সে তার দিদিমার কাছেই কাশীতে থাকে আজকাল। গত বৈশাখ মাসে তাহার বাবা মারা গিয়াছেনলীলার মৃত্যুর পূর্বে। কিন্তু লীলাকে সে সংবাদ জানানো হয় নাই। দেখিতে অবিকল লীলা—এ বয়সে লীলা যা ছিল তাই। কেমন করিয়া অপুর মনে পড়িল শৈশবের একটি দিনে বর্ধমানে লীলাদের বাড়িতে সেই বিবাহ উপলক্ষে মেয়ে মজলিশের কথা—লীলা যেখানে হাসির কবিতা আবৃত্তি করিয়া সকলকে হাসাইয়াছিল—সে-ই লীলাকে সে প্রথম দেখে এবং লীলা তখন দেখিতে ছিল ঠিক এই খুকির মতো অবিকল!
মেজ-বৌরানী বলিলেন—মেয়ে তো ভালো, কিন্তু বাবা, ওর কি আর বিয়ে দিতে পারব? ওর মার কথা যখন সকলে শুনবে—আর তা না জানে কে—এই মেয়ের কি আর বিয়ে হবে বাবা?
অপুর দুর্দমনীয় ইচ্ছা হইল একটি কথা বলিবার জন্য সেটা কিন্তু সে চাপিয়া রাখিল। মুখে বলিল-দেখুন, বিয়ের জন্যে ভাববেন কেন? লেখাপড়া শিখুক, বিয়ে নাই বা হল, তাতে কি? মনে ভাবিল—এখন সে কথা বলব না, থোকা যদি বাঁচে, মানুষ হয়ে ওঠে—তবে সে কথা তুলব। যাইবার সময়ে অপু লীলার মেয়েকে আবার কাছে ডাকিল। এবার খুকি তাহার কাছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া ডাগর ডাগর উৎসুক চোখে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।