পরদিন শনিবার। বোর্ডিং-এর বেশির ভাগ ছেলেই সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে ছুটি লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। অপূর্ব মোট দুই দিন হইল আসিয়াছে; তাহা ছাড়া, যাতায়াতে খরচপত্রও আছে, কাজেই তাহার যাওয়ার কথাই উঠিতে পারে না। কিন্তু তবু তাহার মনে হইল, এই শনিবারে একবার মাকে দেখিয়া আসিলে মন্দ হইত না-সারা শনিবারের বৈকালটা কেমন খালি-খালি ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকিতেছিল।
সন্ধ্যার সময় সে ঘরে আসিয়া আলো জ্বলিল। ঘরে সে একা, সমীর বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, এ রকম চুনকাম-করা ঘরে একা থাকিবার সৌভাগ্য কখনও তাহার হয় নাই, সে খুশি হইয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া নিজের খাটে বসিয়া রহিল। মনে মনে ভাবিল, এইবার সমীরের মতো একটা টেবিল আমার হয়? একটা টেবিলের দাম কত, সমীরকে জিজ্ঞাসা করব।
পরে সে আলোটা লইয়া গিয়া সমীরের টেবিলে পড়িতে বসিল। বুটনে লেখা আছেসোমবারে পাটিগণিতের দিন। অঙ্ককে সে বাঘ বিবেচনা করে। বইখানা খুলিয়া সভয়ে প্রশ্নাবলীর অঙ্ক কয়েকটি দেখিতেছে, এমন সময় দরজা দিয়া ঘরে কে ঢুকিল। কাল রাত্রের সেই শান্ত ছেলেটি। অপুর্ব বলিল-এসো, এসো, বোসো।
ছেলেটি বলিল, আপনি বাড়ি যান নি?
অপু বলিল, না, আমি তো মোটে পরশু এলাম, বাড়িও দূরে। গিয়ে আবার সোমবারে আসা যাবে না।
ছেলেটি অপুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। অপু বলিল-বোর্ডিং-এ যে আজ একেবারেই ছেলে নেই, সব শনিবারেই কি এমনই হয়? তুমি বাড়ি যাও নি কেন? তোমার নামটা কি জানি নে ভাই।
–দেবব্রত বসু-আপনার মনে থাকে না। বাড়ি গেলাম না ইচ্ছে করে? সেকেন মাস্টার ছুটি দিলে না। ছুটি চাইতে গেলাম, বললে, আর শনিবারে গেলে আবার এ শনিবারে কি? হবে না, যাও।
তাহার পর সে বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প করিল। তাহার বাড়ি শহর হইতে মাইল বারো দূরে, ট্রেনে যাইতে হয়। সে শনিবারে বাড়ি না গিয়া থাকিতে পারে না, মন হাঁপাইয়া উঠে, অথচ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছুটি দিতে চায় না। তাহার কথাবার্তার ধরনে অপু বুঝিতে পারিল যে, বাড়ি না। যাইতে পারিয়া মন আজ খুবই খারাপ, অনবরত বাড়ির কথা ছাড়া অন্য কথা সে বড়ো একটা বলিল না। দেবব্রত খানিকটা বসিয়া থাকিয়া অপুর বালিশটা টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল। অনেকটা আপন মনে বলিল, সামনের শনিবারে ছুটি দিতেই হবে, সেকেন মাস্টার না দেয় হেডমাস্টারেব কাছে গিয়ে বলবো।
অপু এ ধরনের দূর প্রবাসে এক রাত্রিবাস করিতে আদৌ অভ্যস্ত নয়, চিরকাল মা-বাপের কাছে কাটাইয়াছে, আজকার রাত্রিটা তাহার সম্পূর্ণ উদাস ও নিঃসঙ্গ ঠেকিতেছিল।
দেবব্রত হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া বসিল, আপনি দেখেন নি বুঝি? জানেন না? আসুন না আপনাকে দেখাই, আসুন উঠে!
পরে সে অপুর হাত ধরিয়া পিছনের দেওয়ালের বড়ো জানালাটার কাছে লইয়া গিয়া দেখাইল, সেটার পাশাপাশি দুটি গরাদে তুলিয়া ফেলিয়া আবার বসানো চলে। একটা লোক অনায়াসে সেই ফাঁকটুকু দিয়া ঘরে যাতায়াত করিতে পারে। বলিল, শুধু সমীরদা আর গণেশ জানে, কাউকে যেন বলবেন না।
একটু পরে বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা পড়িল।
খাওয়ার আগে অপু বলিল, আচ্ছা ভাই, এ কথাটার মানে জানো?
একখণ্ড ছাপা কাগজ সে দেবব্রতকে দেখিতে দিল। বড়ো বড়ো অক্ষরে কাগজখানাতে লেখা আছে-Literature, এত বড়ো কথা সে এ পর্যন্ত কমই পাইয়াছে, অর্থটা জানিবার খুব ক্টৌতুহল। দেবব্রত জানে না, বলিল, চলুন, খাওয়ার সময় মণিদাকে জিজ্ঞেস করবো।
মণিমোহন সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র, দেবব্রত কাগজখানা দেখাইলে সে বলিল, এর মানে সাহিত্য। এ ম্যাকমিলান কোম্পানির বইয়ের বিজ্ঞাপন, কোথায় পেলে?
অপু হাত তুলিয়া দেখাইয়া বলিল, ওই লাইব্রেরির কোণটায় কুড়িয়ে পেয়েছি, লাইব্রেরির ভেতর থেকে কেমন করে উড়ে এসেছে বোধ হয়। কাগজখানার আত্মাণ লইয়া হাসিমুখে বলিল, কেমন ন্যাপথালিনের গন্ধটা।
কাগজখানা সে যত্ন করিয়া রাখিয়া দিল।
হেডমাস্টারকে অপু অত্যন্ত ভয় করে। প্রৌঢ় বয়স, বেশ লম্বা, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ-অনেকটা যাত্রার দলের মুনির মতো। ভারি নাকি কড়া মেজাজের লোক, শিক্ষকেরা পর্যন্ত তঁহাকে ভয় করিয়া চলেন। অপু এতদিন তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া আসিতেছিল। একদিন একটা বড়ো মজা হইল। সত্যেনবাবু ক্লাসে আসিয়া বাংলা হইতে ইংরেজি করিতে দিয়াছেন, এমন সময় হেডমাস্টার ক্লাসে ঢুকিতেই সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। হেডমাস্টার বইখানা সত্যেনবাবুর হাত হইতে লইয়া একবার চোখ বুলাইয়া দেখিয়া লইয়া গম্ভীরস্বরে বলিলেন-আচ্ছা, এই যে এতে ভিক্টর হিউগো কথাটা লেখা আছে, ভিক্টর হিউগো কে ছিলেন জানো?–ক্লাস নীরব। এ নাম কেহ জানে না। পাড়াগায়ের স্কুলের ফোর্থ ক্লাসের ছেলে, কেহ নামও শোনে নাই।–
কে বলিতে পারো।–তুমি-তুমি?
ক্লাসে সূচি পড়িলে তাহার শব্দ শোনা যায়।
অপুর অস্পষ্ট মনে হইল নামটা-যেন তাহার নিতান্ত অপরিচিত নয়, কোথাও যেন সে পাইয়াছে ইহার আগে। কিন্তু তাহার পালা আসিল ও চলিয়া গেল, তাহার মনে পড়িল না। ওদিকের বেঞ্চিটা ঘুরিয়া যখন প্রশ্নটা তাহাদের সম্মুখের বেঞ্চের ছেলেদের কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন তাহার হঠাৎ মনে পড়িল, নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে সেই পুরাতন “বঙ্গবাসী”গুলার মধ্যে কোথায় সে একথাটা পড়িয়ছে-বোধ হয়, সেই “বিলাত যাত্রীর চিঠি’র মধ্যে হইবে। তাহার মনে পড়িয়াছে! পরীক্ষণেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-ফরাসী দেশের লেখক, খুব বড়ো লেখক। প্যারিসে তার পাথরের মূর্তি আছে, পথের ধারে।