পাশেই স্কুলের লাইব্রেরি, ন্যাপাথ্যালিনের গন্ধ-ভরা পুবোনো বই-এর গন্ধ আসিতেছিল। ভাবিল এ ধরনের ভরপুর লাইব্রেরির গন্ধ কি কখনও ছোটখাটো স্কুলে পাওয়া যায়?
ঢং ঢেং করিয়া ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ে-আড়বোয়ালের স্কুলের মতো একখণ্ড রেলেব পাটির লোহা বাজায় না, সত্যিকারের পেটা ঘড়ি।-কি গভীর আওয়াজটা!.
টিফিনের পরের ঘণ্টায় সত্যেনবাবুর ক্লাস। চব্বিশ-পাঁচিশ বৎসরের যুবক, বেশ বলিষ্ঠ গড়ন, ইহার মুখ দেখিয়া অপুর মনে হইল ইনি ভাবি বিদ্বান, বুদ্ধিমানও বটে। প্রথম দিনেই ইহাব উপর কেমন এক ধরনের শ্রদ্ধা তাহার গড়িয়া উঠিল! সে শ্ৰদ্ধা আরও গভীর হইল ইহার মুখের ইংবিজি উচ্চারণে।
ছুটির পর স্কুলের মাঠে বোর্ডিং-এব ছেলেদের নানা ধরনের খেলা শুরু হইল। তাঁহাদেব ক্লাসের ননী ও সমীর তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়া অন্য সকল ছেলেদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। সে ক্রিকেট খেলা জানে না, ননী তাহার হাতে নিজের ব্যাটখানা দিযা তাহাকে বল মারিতে বলিল ও নিজে উইকেট হইতে একটু দূরে দাঁড়াইয়া খেলার আইনকানুন বুঝাইযা দিতে লাগিল।
খেলার অবসানে যে-যাহাব স্থানে চলিয়া গেল। খেলার মাঠে পশ্চিম কোণে একটা বড়ো বাদাম গাছ, অপু গিয়া তাহার তলায় বসিল। একটু দূরে গবর্নমেন্টের দাতব্য ঔষধালয়। বৈকালেও সেখানে একদল বোগীর ভিড় হইয়াছে, তাহাদের নানা কলরবের মধ্যে একটি ছোট মেয়ের কান্নার সুর শোনা যাইতেছে। অপূর্ব কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল। চৌদ-পনেরো বৎসর বয়সের মধ্যে এই আজ প্রথম দিন, যেদিনটি সে মায়ের নিকট হইতে বহু দূরে আত্মীয়-বন্ধুহীন প্রবাসে একা কাটাইতেছে। সেদিক দিয়া দেখিতে গেলে আজ তাহার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
কত কথা মনে ওঠে, এই সুদীর্ঘ পনেরো বৎসরের জীবনে কি অপূর্ব বৈচিত্ৰ্য, কি ঐশ্বর্য।
সমীর টেবিলে আলো জ্বালিয়াছে। অপুর কিছু ভালো লাগিতেছিল না-বিছানায় গিয়া শুইয়া রহিল। খানিকটা পরে সমীর পিছনে চাহিয়া তাহকে সে অবস্থায় দেখিয়া বলিল, পড়বে না?
–আলোটা জ্বলিয়ে রাখো, সুপারিন্টেন্ডেন্ট এখুনি দেখতে আসবে, শুয়ে আছ দেখলে বাকবে।
অপু উঠিয়া আলো জ্বলিল। বলিল, রোজ আসেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট? সেকেন্ড মাস্টার তো-না?
সমীরের কথা ঠিক। অপু আলো জালিবার একটু পরেই বিধুবাবু ঘরে ঢুকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রকম লাগলো। আজ ক্লাসে? পড়াশুনো সব দেখে নিয়েচ তো? সমীর, ওকে একটু দেখিয়ে দিস তো কোথায় কিসের পড়া। ক্লাসের বুটনটো ওকে লিখে দে বরং-সব বই কোেনা হয়েচে তো তোমার?.জিওমেট্রি নেই? আচ্ছা, আমার কাছে পাওয়া যাবে, এক টাকা সাড়ে পাঁচ আনা, কাল সকালে আমার ঘর থেকে গিয়ে নিয়ে এসো একখানা।
বিধুবাবু চলিয়া গেলে সমীর পড়িতে বসিল; কিন্তু পিছনে চাহিয়া পুনরায় অপূর্বকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে কাছে আসিয়া বলিল, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে।–না?
তাহার পর সে খাটের ধারে বসিয়া তাহাকে বাড়ির সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। বলিল, তোমার মা একা থাকেন বাড়িতে? আর কেউ না? তার তো থাকতে কষ্ট হয়।
অপূর্ব বলিল, ও কিসের ঘণ্টা ভাই?
–বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা-চলে যাই।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুই-তিনজন ছেলে তাহাদের ঘরে আসিল। এই সময়টা আর সুপারিন্টেন্ডেন্টের ভয় নাই, তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। শীতের রাত্রে আর বড়ো একটা বাহির হন না। ছেলেরা এই সময়ে এঘর-ওঘর বেড়াইয়া গল্পগুজবের অবকাশ পায়। সমীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, এসো নৃপেন, এই আমার খাটে বসো-শিশির যাও ওখানে-অপূর্ব জানো তাস খেলা?
নৃপেন বলিল, হেডমাস্টার আসবে না তো?
শিশির বলিল, হঁবা, এত রাত্তিরে আবার হেডমাস্টার—
অপূর্বও তাঁস খেলিতে বসিল বটে। কিন্তু শীঘ্রই বুঝিতে পারিল, মায়ের ও দিদির সঙ্গে কত কাল আগে খেলার সে বিদ্যা লইয়া এখানে তাসখেলা খাটিবে না। তাসখেলায় ইহারা সব ঘুণ, কোন হাতে কি তাস আছে সব ইহাদের নখদর্পণে। তাহা ছাড়া এতগুলি অপরিচিত ছেলের সম্মুখে তাহাকে তাহার পুরাতন মুখচোরা রোগে পাইয়া বসিল; অনেক লোকের সামনে সে মোটেই স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলিতে পারে না। মনে হয়, কথা বলিলেই হয়তো ইহার হাসিয়া উঠিবে। সে সমীরকে বলিল, তোমরা খেলো, আমি দেখি। শিশির ছাড়ে না। বলিল, তিনদিনে শিখিয়ে দেব, ধরে দিকি তাস!
বাহিরো যেন কিসের শব্দ হইল। শিশির সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়া গেল এবং হাতের তাস লুকাইয়া পরের পাঁচ মিনিট এমন অবস্থায় রহিল যে সেখানে একটা কাঠের পুতুল থাকিলে সেটাও তাহার অপেক্ষা বেশি নড়িত। সকলেরই সেই অবস্থা। সমীর টেবিলের আলোটা একটু কম৷ইয়া দিল। আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না। নৃপেন একবার দরজার ফাঁক দিয়া বাহিরের বারান্দাতে উঁকি মারিয়া দেখিয়া আসিয়া নিজের তাস সমীরের তেশকের তলা হইতে বাহির করিয়া বলিল, ও কিছু না, এসো এসো-তোমার হাতের খেলা শিশির।
রাত এগারোটার সময় পা টিপিয়া টিপিয়া যে যাহার ঘরে চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের রোজ এমনি হয় নাকি? কেউ টের পায় না? আচ্ছা, চুপ করে বসেছিল, ও ছেলেটা কে?
ছেলেটাকে তাহার ভালো লাগিয়াছে। ঘরে ঢুকিবার পর হইতে সে বেশি কথা বলে নাই, তাহার কাঠের কোণটিতে নীরবে বসিয়া ছিল। বয়স তেরো-চোঁদ হইবে, বেশ চেহারা। ইহাদের দলে থাকিয়াও সে এতদিনে তাসখেলা শেখে নাই, ইহাদের কথাবার্তা হইতে অপূর্ব বুঝিয়াছিল।