যাত্রার পূর্বে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের দধির ফোটা অপুর কপালে পরাইয়া দিতে দিতে বলিলবাড়ি আবার শিগগির শিগগির আসবি কিন্তু, তোদের ইতুপুজোর ছুটি দেবে তো?
-হ্যাঁ, ইস্কুলে বুঝি ইতুপুজোয় ছুটি হয়? তাতে আবার বড়ো ইস্কুল। সেই আবার আসবো গরমের ছুটিতে।
ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় উচ্ছ্বসিত চোখের জল বহু কষ্ট সর্বজয়া চাপিয়া রাখিব।
অপু মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া ভারী বোঁচকাটা পিঠে ঝুলাইয়া লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া গেল।
মাঘ মাসের সকাল। কাল একটু একটু মেঘ ছিল, আজ মেঘ-ভাঙা রাঙা রোদ কুতুবাড়ির দোফলা আম গাছের মাথায় ঝলমল করিতেছে-বাড়ির সামনে বাঁশবনের তলায় চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে বুনো আদার রঙিন ফুল যেন দূর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নের মতো সকালের বুকে।
০২. সবে ভোর হইয়াছে
সবে ভোর হইয়াছে। দেওয়ানপুর গবর্নমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউশনের ছেলেদের বোর্ডিং-ঘরের সব দরজা এখনও খুলে নাই। কেবল স্কুলের মাঠে দুইজন শিক্ষক পায়চারি করিতেছেন। সম্মুখের রাস্তা দিয়া এত ভোরেই গ্রাম হইতে গোয়ালারা বাজারে দুধ বেচিতে আনিতেছিল, একজন শিক্ষক আগইয়া আসিয়া বলিলেন–দাঁড়াও, ও ঘোষের পো, কাল দুধ দিয়ে গেলে তো নিছক জল, আজ দেখি কেমন দুধটা!
অপর শিক্ষকটি পিছু পিছু আসিয়া বলিলেন, নেবেন না সত্যেনবাবু, একটু বেলা না গেলে ভালো দুধ পাওয়া যায় না। আপনি নতুন লোক, এসব জায়গার গতিক জানেন না, যার-তার কাছে দুধ নেবেন না-আমার জানা গোয়ালা আছে, কিনে দেবো বেলা হলে।
বোর্ডিং-বাড়ির কোণের ঘরে দরজা খুলিয়া একটি ছেলে বাহির হইয়া আসিল ও দূরের করোনেশন ক্লক-টাওয়ারের ঘড়িতে কয়টা বাজিয়াছে চাহিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল। সত্যেনবাবুর সঙ্গী শিক্ষকটির নাম রামপদবাবু, তিনি ডাকিয়া বলিলেন-ওহে সমীর, ওই যে ছেলেটি এবার ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছে, সে কাল রাত্রে এসেছে না?
ছেলেটি বলিল, এসেছে স্যার, ঘুমুচ্ছে এখনও। ডেকে দেবো?-পরে সে জানালার কাছে গিয়া ডাকিল, অপূর্ব, ও অপূর্ব।
ছিপছিপে পাতলা চেহারা, চোদ-পনেরো বৎসরের একটি খুব সুন্দর ছেলে চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল। রামপদবাবু বলিলেন, তোমার নাম অপূর্ব ও–এবার আড়বোয়ালের স্কুল থেকে স্কলারশিপ পেয়েছ?-বাড়ি কোথায়? ও! বেশ বেশ, আচ্ছা, স্কুলে দেখা হবে।
সমীর জিজ্ঞাসা করিল, স্যার, অপূর্ব কোন ঘরে থাকবে এখনও সেকেন মাস্টার মশায় ঠিক করে দেন নি। আপনি একটু বলবেন?
রামপদবাবু বলিলেন, কেন, তোর ঘরে তো সীট খালি রয়েছে-ওখানেই থাকবে।
সমীর বোধ হয় ইহাই চাহিতেছিল, বলিল-আপনি একটু বলবেন তাহলে সেকেন—
রামপদবাবু চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কে? পরে পরিচয় শুনিয়া সে একটু আঁপ্ৰতিভ হইল। হয়তো বোর্ডিং-এর নিয়ম নাই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, সে না জানিয়া শুনিয়া প্রথম দিনটাতেই হয়তো একটা অপরাধের কাজ করিয়া বসিয়াছে।.
একটু বেলা হইলে সে স্কুল-বাড়ি দেখিতে গেল। কাল অনেক রাত্রে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, ভালো করিয়া দেখিবার সুযোগ পায় নাই। রাত্রের অন্ধকারে আবছায়া-দেখিতে-পাওয়া সাদা রং-এর প্ৰকাণ্ড স্কুল বাড়িটা তাহার মনে একটা আনন্দ ও রহস্যের সঞ্চার করিয়াছিল।
এই স্কুলে সে পড়িতে পাইবে!..কতদিন শহরে থাকিতে তাহাদের ছোট স্কুলটা হইতে বাহির হইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিতে পাইত-হাই স্কুলের প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডে ছেলেরা সকলেই এক ধরনের পোশাক পরিয়া ফুটবল খেলিতেছে। তখন কতদিন মনে হইয়াছে এত বড়ো স্কুলে পড়িতে যাওয়া কি তাহার ঘটিবে কোন কালে-“এসব বড়োলোকের ছেলেদের জন্য। এতদিনে তাহার। আশা পূর্ণ হইতে চলিল।
বেলা দশটার কিছু আগে বোর্ডিং-সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সে কোন ঘরে আছে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, নানা জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া বলিলেন, সমীর ছোকরা ভালো, একসঙ্গে থাকলে বেশ পড়াশুনো হবে। এখানকার পুকুরের জলে নাইবে না। কখনও-জািল ভালো নয়, স্কুলের ইন্দারার জলে ছাড়া-আচ্ছা যাও, এদিকে আবার ঘণ্টা বাজবার সময় হল।
সাড়ে দশটায় ক্লাস বসিল। প্রথম বই খাতা হাতে ক্লাস-বুমে ঢুকিবার সময় তাহার বুক আগ্রহের ঔৎসুক্যে টিপ টিপ করিতেছিল। বেশ বড়ো ঘর, নিচু চৌকির উপর মাস্টারের চেয়ার পাতা-খুব বড়ো ব্ল্যাকবোর্ড। সব ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিখুঁতভাবে সাজানো। চেয়ার, বেঞ্চি, টেবিল, ডেস্ক সব ঝকঝকি করিতেছে, কোথাও একটু ময়লা বা দাগ নাই।
মাস্টারক্লাসে ঢুকিলে সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। এ নিয়ম পূর্বে সে যেসব স্কুলে পড়িত সেখানে দেখে নাই। কেহ স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিলে উঠিয়া দাঁড়াইবার কথা মাস্টার শিখাইয়া দিতেন। সত্য সত্যই এতদিন পরে সে বড়ো স্কুলে পড়িতেছে বটে।.
জানোলা দিয়া চাহিয়া দেখিল পাশের ক্লাসরুমে একজন কোট-প্যান্টপরা মাস্টার বোর্ডে কি লিখিতে দিয়া ক্লাসের এদিক-ওদিক পায়চারি করিতেছেন-চোখে চশমা, আধাপাকা দাড়ি বুকেব উপর পড়িয়াছে, গভীর চেহারা। সে পাশের ছেলেকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল,-উনি কোন মাস্টার ভাই?
ছেলেটি বলিল-উনি মিঃ দত্ত, হেডমাস্টার-কিশচান, খুব ভালো ইংরিজি জানেন।
অপূর্ব শুনিয়া নিরাশ হইল যে, তাহাদের ক্লাসে মিঃ দত্তের কোন ঘণ্টা নাই। থার্ড ক্লাসের নিচে কোন ক্লাসে তিনি নাকি নামেন না।