বাড়িতে তাহার মাও আজ সারাদিন খায় নাই। ভাত চাহিয়া না পাইয়া ছেলে না খাইয়াই চলিয়া গিয়াছে স্কুলে-সৰ্বজয়া কি করিয়া খাবারের কাছে বসে? কুলুইচণ্ডীর ফলার খাইয়া অপু বৈকালে বেড়াইতে গেল।
গ্রামের বাহিরে ধঞ্চেক্ষেতের ফসল কাটিয়া লওয়া হইয়াছে। চারি ধারে খোলা মাঠ পড়িয়া আছে। আবার সেই সব রঙিন কল্পনা; সে পরীক্ষায় বৃত্তি পাইয়াছে। তার স্বপ্নের অতীত! মোটে এক বছর পড়িয়াই বৃত্তি পাইল!…সুমুখের জীবনের কত ছবিই আবার মনে আসে। ওই মাঠের পারে রক্তআকাশটার মতো। রহস্যস্বপ্নভরা যে অজানা অকুল জীবন-মহাসমুদ্র.পুলকে সারাদেহ শিহরিয়া উঠে। মাকে এখনও সব কথা বলা হয় নাই। মায়ের মনের বেদনার রঙে যেন মাঠ, ঘাট, অস্তদিগন্তের মেঘমালা রাঙানো। গভীর ছায়াভরা সন্ধ্যায় মায়ের দুঃখভরা মনটার মতো ঘুলি-ঘুলি অন্ধকার।
দালানের পাশের ঘরে মিটি মিটি প্ৰদীপ জ্বলিতেছে। সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় ছেলেকে ওবেলার কুলুইচণ্ডী-ব্রতের চিড়ে-মুড়কির ফলার খাইতে দিল। নিকটে বসিয়া চাপাকলার খোসা ছাড়াইয়া দিতে দিতে বলিল, ওরা কত দুঃখু করলে আজ। সরকারবাড়ি থেকে বলে গেল তুই পুজো করবি-তারা খুঁজতে এলে আমি বললাম, সে স্কুলে চলে গিয়েছে। তখন তারা আবার ভৈরব চক্কত্তিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই অত বেলায়–তুই যদি যেতিস–
—আজি না গিয়ে ভালো করিচি মা। আজ হেডমাস্টার বলেচে। আমি এগজামিনে স্কলারশিপ পেইচি। বড়ো স্কুলে পড়লে মাসে পাঁচ টাকা করে পাবো। স্কুলে যেতেই হেডমাস্টার ডেকে বললে–
সর্বজয়ার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোথায় পড়তে হবে?
–মহকুমার বড়ো স্কুলে।
–তা তুই কি বললি?
–আমি কিছু বলি নি। পাঁচটা করে টাকা মাসে মাসে দেবে, যদি না পড়ি তবে তো আর দেবে না। ওতে মাইনে ফ্রি করে নেবে। আর ওই পাঁচ টাকাতে বোর্ডিং-এ থাকবার খরচও কুলিয়ে যাবে।
সর্বজয়া আর কোন কথা বলিল না। কি কথা সে বলিবে? যুক্তি এতই অকাট্য যে, তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার কিছুই নাই। ছেলে স্কলারশিপ পাইয়াছে, শহরে পড়িতে যাইবে, ইহাতে মাবাপের ছেলেকে বাধা দিয়া বাড়ি বসাইয়া রাখিবার পদ্ধতি কোথায় চলিত আছে? এ যেন তাহার বিরুদ্ধে কোন দণ্ডী তার নির্মম অকাট্য দণ্ড উঠাইয়াছে তাহার দুর্বল হাতের সাধ্য নাই যে ঠেকাইয়া রাখে। ছেলেও ওইদিকে ঝুঁকিয়াছে! আজিকার দিনটিই যেন কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিল সে। ভবিষ্যতের সহস্ৰ সুখস্বপ্ন কুয়াশার মতো অনন্তে বিলীন হইয়া যাইতেছে কেন আজকের দিনটিতে বিশেষ করিয়া?
মাসখানেক পরে বৃত্তি পাওয়ার খবর কাগজে পাওয়া গেল।
যাইবার পূর্বদিন বৈকালে সর্বজয়া ব্যস্তভাবে ছেলের জিনিসপত্র গুছাইয়া দিতে লাগিল। ছেলে কখনও একা বিদেশে বাহির হয় নাই, নিতান্ত আনাড়ী, ছেলে-মানুষ ছেলে। কত জিনিসের দরকার হইবে, কে থাকিবে তখন সেখানে যে মুখে মুখে সব অভাব জোগাইয়া ফিরিবে, সব জিনিস হাতে লাইয়া বসিয়া থাকিবো? খুঁটিনাটি-একখানা কাঁথা পাতিবার, একখানি গায়ের-একটি জল খাইবার গ্লাস, ঘরের তৈরি এক শিশি সরের ঘি, এক পুঁটুলি নারিকেল নাড়ু, অপু ফুলকটা একটা মাঝারি জামবাটিতে দুধ খাইতে ভালোবাসে-সেই বাটিটা, ছোট একটা বোতলে মাখিবার চৈ-মিশানো নারিকেল তৈল, আরও কত কি। অপুর মাথার বালিশের পুরানো ওয়াড় বদলাইয়া নূতন ওয়াড় পরাইয়া দিল। দধি-যাত্রার আবশ্যকীয় দই একটা ছোট পাথরবাটিতে পাতিয়া রাখিল। ছেলেকে কি করিয়া বিদেশে চলিতে হইবে সে বিষয়ে সহস্র উপদেশ দিয়াও তাহার মনে তৃপ্তি হইতেছিল না। ভাবিয়া দেখিয়া যেটি বাদ দিয়াছে মনে হয় সেটি তখনই আবার ডাকিয়া বলিয়া দিতেছিল।
—যদি কেউ মারে-টারে, কত দুন্টু ছেলে তো আচে, আমনি মাস্টারকে বলে দিবি-বুঝলি? রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়িসা নে যেন ভাত খাবার আগে! এ তো বাড়ি নয় যে কেউ তোকে ওঠাবেখেয়ে তবে ঘুমুদ্বি-নিয়তো তাদের বলবি, যা হয়েচে তাই দিয়ে ভাত দাও-বুঝলি তো?
সন্ধ্যার পর সে কুণ্ডুদের বাড়ি মনসার ভাসান শুনিতে গেল। অধিকারী নিজে বেহুলা সাজিয়া পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া নাচে-কেশ গানের গলা। খানিকটা শুনিয়া তাহার ভালো লাগিল না। শুধু ছড়া কাটা ও নাচ সে পছন্দ করে না,-যুদ্ধ নাই, তলোয়ার খেলা নাই, যেন পানসে-পানসে।
তবুও আজিকার রাতটি বড়ো ভালো লাগিল তাহার। এই মনসা ভাসানোর আসর, এই নূতন জায়গা, এই অচেনা গ্ৰাম্য বালকের দল, ফিরিবার পথে তাঁহাদের পাড়ার বাঁকে প্রস্ফুটিত হেনা ফুলেব গন্ধ-ভরা নৈশ বাতাস জোনাকি-জুলা অন্ধকারে কেমন মায়াময় মনে হয়।.
রাত্রে সে আরও দু-একটা জিনিস সঙ্গে লইল। বাবার হাতের লেখা একখানা গানের খাতা, বাবার উদ্ভট শ্লোকের খাতাখানা বড়ো পেটরাটা হইতে বাহির করিয়া রাখিল-বড়ো বড়ো গোটা গোটা ছাঁদের হাতের লেখাটা বাবার কথা মনে আনিয়া দেয়। গানগুলির সঙ্গে বাবার গলার সুর এমনভাবে জড়াইয়া আছে যে, সেগুলি পড়িয়া গেলেই বাবাব সুর কানে বাজে। নিশ্চিন্দিপুরের কত ক্রীড়াক্কাস্ত শান্ত সন্ধ্যা, মেঘমেদুর বর্ষামধ্যাহ্ন, কত জ্যোৎস্না-ভরা রহস্যময়ী রাত্রি বিদেশ-বিভুই-এব সেই দুঃখ-মাখানো দিনগুলির সঙ্গে এই গানের সুরা যেন জড়াইয়া আছে–সেই দশাশ্বমেধ ঘাটের রানা, কাশীর পরিচিত সেই বাঙালি কথকঠাকুর।
সর্বজয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, হয়তো ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাইবার মত করিবে না। কিন্তু তাহার অপু যে পিছনেব দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না। সে যে এত খাটিয়া, একেওকে বলিয়া কহিয়া তাহার সাধ্যমতো যতটা কুলায়, ছেলেব ভবিষ্যৎ জীবনের অবলম্বন একটা খাড়া করিয়া দিয়াছিল–ছেলে তাহার পায়ে দলিয়া যাইতেছে–কি জানি কিসের টানে! কোথায়? তাহার মেহদুর্বল দৃষ্টি তাহাকে দেখিতে দিতেছিল না যে, ছেলের ডাক আসিয়াছে বাহিরের জগৎ হইতে। সে জগৎটা তাহার দাবি আদায় করিতে তো ছাড়িবে না-সাধ্য কি সর্বজয়ার যে চিরকাল ছেলেকে আঁচলে লুকাইয়া রাখে?