সাঁকোর নিচের জলে হাত মুখ ধুইতে নামিতে গিয়া হঠাৎ তাহার চোখ পড়িল একজন ঝাঁকড়া-চুল কালোমতো লোক রাস্তার ধারের মাঠে নামিয়া লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু কৌতূহলী হইয়া চাহিয়া রহিল। লোকটা খুব লম্বা নয়, বেঁটে ধরনের, শক্ত হাত পা, পিঠে একগাছা বড়ো ধনুক, একটা বড়ো বেঁচেকা, মাথার চুল লম্বা লম্বা, গলায় রাঙা সবুজ হিংলাজের মালা। সে অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া ডাকিয়া বলিল, ওখানে কি খুঁজচো? পরে লোকটির সঙ্গে তাহার আলাপ হইল। সে জাতিতে সাঁওতাল, অনেক দূরে কোথায় দুমকা জেলা আছে, সেখানে বাড়ি। অনেক দিন বর্ধমানে ছিল, বাঁকা বাঁকা বাংলা বলে, পায়ে হ্যাঁটিয়া সেখান হইতে আসিতেছে। গন্তব্য স্থান অনিৰ্দেশ্যএরূপে যতদূর যাওয়া যায় যাইবে, সঙ্গে তীর ধনুক আছে, পথের ধারে বনে মাঠে যাহা শিকার মেলে-তাহাই খায়। সম্প্রতি একটা কি পাখি মারিয়াছে, মাঠের কোন ক্ষেত হইতে গোটকয়েক বড়ো বড়ো বেগুনও তুলিয়াছে-তোহ্যাঁই পুড়াইয়া খাইবার জোগাড়ে শুকনো লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু বলিল, কি পাখি দেখি? লোকটা ঝোলা হইতে বাহির করিয়া দেখাইল একটা বড়ো হড়িয়াল ঘুঘু। সত্যিকারের তীর ধনুক-যাহাতে সত্যিকারের শিকার সম্ভব হয়-অপু কখনও দেখে নাই। বলিল, দেখি একগাছা তীর তোমার? পরে হাতে লইয়া দেখিল, মুখে শক্ত লোহার ফলা, পিছনে বুনোেপাখির পালক বাঁধা-অদ্ভুত কৌতূহলপ্রদ ও মুগ্ধকর জিনিস!
–আচ্ছা এতে পাখি মারে, আর কি মরে?
লোকটা উত্তর দিল, সবই মারা যায়-খরগোশ, শিয়াল, বেজি, এমন কি বাঘ পর্যন্ত। তবে বাঘ মারিবার সময় তীরের ফলায় অন্য একটা লতার রস মাখাইয়া লইতে হয় …তাহার পর সে তুঁতগাছতলায় শুকনা পাতা লতার আগুন জ্বলিল। অপুর পা আর সেখান হইতে নড়িতে চাহিল না-মুগ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, লোকটা পাখিটার পালক ছাড়াইয়া আগুনে ঝলসাইতে ছিল, বেগুনগুলাও পুড়াইতে দিল।
বেলা অত্যন্ত পড়িলে অপু বাড়ি রওনা হইল। আহার শেষ করিয়া লোকটা তখন তাহার বেঁচেক ও তীর ধনুক লইয়া রওনা হইয়াছে। এ রকম মানুষ সে তো কখনও দেখে নাই। বাঃযেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকে যাওয়া-পথে পথে তীর ধনুক দিয়া শিকার করা, বনের লতাপাতা কুড়াইয়া গাছতলায় দিনের শেষে বেগুন পুড়াইয়া খাওয়া! গোটা আষ্টেক বড়ো বড়ো বেগুন সামান্য একটু নুনের ছিটা দিয়া গ্রাসের পর গ্রাস তুলিয়া কি করিয়াই নিমেষের মধ্যে সাবাড়া করিয়া ফেলিল।…
মাস কয়েক কাটিয়া গেল। সকালবেলা স্কুলের ভাত চাহিতে গিয়া অপু দেখিল রান্না চড়ানো হয় নাই। সর্বজয়া বলিল, আজ যে কুলুইচণ্ডী পুজো-আজি স্কুলে যাবি কি করে?…ওরা বলে গিয়েচে ওদের পুজোটা সেরে দেওয়ার জন্যে-পুজোবারে কি আর স্কুলে যেতে পারবি? বড় দেরি হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ, তাই বইকি? আমি পুজো করতে গিয়ে স্কুল কামাই করি আর কি? আমি ওসব পারবো না, পুজোঁটুজো আমি আর করবো কি করে, রোজই তো পুজো লেগে থাকবে। আর আমি বুঝি রোজ রোজ-তুমি ভাত নিয়ে এসো আমি ওসব শুনছিনে-।
-লক্ষ্মী বাবা আমার। আচ্ছা, আজকের দিনটা পুজোটা সেরে নে। ওরা বলে গিয়েছে ওপাড়াসুদ্ধ পুজো হবে। চাল পাওয়া যাবে এক ধামার কম নয়, মানিক আমার, কথা শোনো, শুনতে হয়।
অপু কোন মতেই শুনিল না। অবশেষে না খাইয়াই স্কুলে চলিয়া গেল। সর্বজয়া ভাবে নাই যে, ছেলে সত্যসত্যই তাহার কথা ঠেলিয়া না খাইয়া স্কুলে চলিয়া যাইবে। যখন সত্যই বুঝিতে পারিল, তখন তাহার চোখের জল আর বাধা মানিল না। ইহা সে আশা করে নাই।
অপু স্কুলে পৌঁছিতেই হেডমাস্টার ফণীবাবু তাহাকে নিজের ঘরে ডাক দিলেন। ফণীবাবুর ঘরেই স্থানীয় ব্রাঞ্চ পোস্ট-অফিস, ফণীবাবুই পোস্ট-মাস্টার। তিনি তখন ডাকঘরের কাজ করিতেছিলেন। বলিলেন, এসো অপূর্ব, তোমার নম্বর দেখবো? ইন্সপেক্টর অফিস থেকে পাঠিয়ে দিয়েচে-বোর্ডের এগজামিনে তুমি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েচ–পাঁচ টাকার একটা স্কলারশিপ পাবে। যদি আরও পড়ো’তবে। পড়বে তো?
এই সময়ে তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ঘরে ঢুকিলেন। ফণীবাবু বলিলেন, ওকে সে কথা এখন বললাম পণ্ডিতমশাই! জিজ্ঞাসা করচি, আরও পড়বে তো? তৃতীয় পণ্ডিত বলিলেন, পড়বে না, বাঃ! হীরের টুকরো ছেলে, স্কুলের নাম রেখেছে। ওরা যদি না পড়ে তো পড়বে কে, কেষ্ট তেলির বেটা গোবর্ধন? কিছু না, আপনি ইন্সপেক্টর অফিসে লিখে দিন যে, ও হাই স্কুলে পড়বে। ওর আবার জিজ্ঞেসটা কি?-ওঃ, সোজা পরিশ্রম করিচি মশাই ওকে ভগ্নাংশটা শেখাতে?
প্রথমটা অপু যেন ভালো করিয়া কথাটা বুঝিতে পারিল না। পরে যখন বুঝিল তখন তাঁহার মুখে কথা জোগাইল না। হেডমাস্টার একখানা কাগজ বাহির করিয়া তাহার সামনে ধরিয়া বলিলেন—এইখানে একটা নাম সই করে দাও তো। আমি কিন্তু লিখে দিলাম যে, তুমি হাই স্কুলে পড়বে। আজই ইন্সপেক্টর অফিসে পাঠিয়ে দেবো।
সকাল সকাল ছুটি লইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে মায়ের করুণ মুখচ্ছবি বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। পথের পাশে দুপুরের রৌদ্রভরা শ্যামল মাঠ, প্রাচীন তুঁত বটগাছের ছায়া, ঘন শালপত্রের অন্তরালে ঘুঘুর উদাস কণ্ঠ, সব যেন করুণ হইয়া উঠিল। তাহার মনে এই অপূর্ব করুণ ভাবটি বড়ো গভীর ছাপ রাখিয়া গিয়াছিল। আজিকার দুপুরটির কথা উত্তর জীবনে বড়ো মনে আসিত তাহার। কত-কতদিন পরে আবার এই শ্যামচ্ছায়াভিরা বীথি, বাল্যের অপরূপ জীবনানন্দ, ঘুঘুর ডাক, মায়ের মনের একদিনের দুঃখটি-অনস্তের মণিহারে গাঁথা দানাগুলির একটি, পশ্চিম দিগন্তে প্রতি সন্ধ্যায় ছিঁড়িয়া-পড়া, বহুবিস্মৃত মুক্তাবলীর মধ্যে কেমন করিয়া অক্ষয় হইয়া ছিল।