–আমরা কে? দয়া করবারই বা কি আছে? তিনি কাউকে ফেলবেন না, তা তুমি তো তুমি! তুমি কি তাঁর পর?
রামকানাই কবিরাজের দিকে চেয়ে বললেন–ওহে কবিরাজমশাই, আপনি যে দেখচি ভবরোগের কবিরাজ সেজে বসলেন শেষে। দেখে সুখী হলাম।
রামকানাই বললে–ভবরোগটা কি?
–সে তো ধরুন, গানেই আছে–
ভবরোগের বৈদ্য আমি
অনাদরে আসিনে ঘরে।
–বোঝলাম। জিনিসটা কি?
–আমার মনে হয়, ভবরোগ মানে অজ্ঞানতা। অর্থের পেছনে অত্যন্ত ছোটাছুটি। কেন, ঘরে দুটো ধান, উঠোনে দুটো ডাঁটাশাক–মিটে গেল অভাব, আপনার মতো। এখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে মায়ের পেটের এক ভাই গরিব, এক ভাই ধনী।
–আমার কথা বাদ দ্যান। আমার টাকা রোজগার করার ক্ষমতা নেই তাই। থাকলি আমিও করতাম।
–করতেন না। আপনার মনের গড়ন আলাদা। বৈষয়িক কূটবুদ্ধি লোক আপনি দেখেন নি তাই এ কথা বলছেন। কি জানেন, তত্ত্বকে একটু বেশি সামনে রাখেন তিনি। তাকে আপনার জন ভাবেন। এ বড় গূঢ় তত্ত্ব।
–ও কথা ছেড়ে দ্যান জামাইবাবু। যায় যা, তার সেটা সাজে আমার ভালো লাগে এই মাটির কুঁড়ে, তাই থাকি। যার না লাগে, সে অন্য চেষ্টা করে।
–তারা কি আপনার চেয়ে আনন্দ পায় বেশি? সুখ পায় বেশি? কখনো না। আনন্দ আত্মার ধর্ম, মন যত আত্মার কাছে যাবে, তত সে বেশি আনন্দ পাবে–আত্মার থেকে দূরে যত যাবে, বিষয়ের দিকে যাবে, তত দুঃখ পাবে। বাইরে কোথাও আনন্দ নেই, আনন্দ শান্তির উৎস রয়েছে মানুষের নিজের মধ্যে। মানুষ চেনে না, বাইরে ছোটে। নাভিগন্ধে মত্ত মৃগ ছুটে ফেরে গন্ধ অন্বেষণে। তারা সুখ পায় না।
–সে তারা জানে। আমি কি বলবো? আমি এতে সুখ পাই, আনন্দ পাই, এইটুকু বলতে পারি। আনন্দ ভেতরেই, এটুকু বুঝিচি। নিজের মধ্যিই খুব।
খোকা পুনরায় একমনে বসে এইসব জটিল কথাবার্তা শুনছিল। ওর বড় বড় দুই চোখে বুদ্ধি ও কৌতূহলের চাহনি।
গয়ামেমের কি ভালোই লাগলো ওকে! কাছে এসে ডেকে চুপি চুপি বললে–ও খোকা, তোমার নাম কি?
–টুলু।
–মোর সঙ্গে যাবা?
–কোথায়?
–মোর বাড়ি। পেঁপে খেতি দেবানি।
–বাবা বললি যাবো।
–আমি বললি যেতি দেবেন না কেন?
–হুঁ, নিয়ে যেও। অনেকদ্দূর তোমার বাড়ি?
–আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। যাবা ও বাবা? যাবা ঠিক?
খোকা ভেবে বললে–পেঁপে আছে?
–নেই আবার! এই এত বড় পেঁপে—
গয়া দুই হাত প্রসারিত করে ফলের আকৃতি যা দেখালে, তাতে লাউ কুমড়োর বেলায় বিশ্বাস হতো কিন্তু পেঁপের ক্ষেত্রে যেন একটু অতিরঞ্জিত বলে সন্দেহ হয়।
খোকা বললে–বাবা, ও বাবা, মাসিমার বাড়ি যাব? পেঁপে দেবে–
বাবার বিনা অনুমতিতে সে কোনো কাজ করে না। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে রইল।
.
গয়ামেম রাত্রে এসে রইল চরপাড়ায় ওর দূর-সম্পর্কের এক ভগ্নীর বাড়ি। সকালে উঠে সে চলে যাবে মোল্লাহাটি। ঠিক মোল্লাহাটি নয়, ওর গ্রাম গয়েশপুরে। ওর দূর-সম্পর্কের বোনের নাম নীরদা, নীরি বাগদিনী বলে গ্রামে পরিচিত। তার অবস্থা ভালো না, আজ সন্ধ্যাবেলা গয়া এসে পড়াতে এবং রাত্রে থাকবে বলাতে নীরি একটু বিপদে পড়ে গিয়েছিল। কি খাওয়ায়? একসময়ে এই অঞ্চলের নামকরা লোক ছিল গয়ামেম। খেয়েচে দিয়েছেও অনেক। তাকে যা-তা দিয়ে ভাত দেওয়া যায়? কুচো চিংড়ি দিয়ে ঝিঙের ঝোল আর রাঙা আউশ চালের ভাত তাই দিতে হল। তারপর একটা মাদুর পেতে একখানা ক্যাঁথা দিলে ওকে শোওয়ার জন্যে।
গয়ার শুয়ে শুয়ে ঘুম এল না।
ওই খোকার মুখখানা কেবলই মনে পড়ে। অমন যদি একটা খোকা থাকতো তার?
আজ যেন সব ফাঁকা, সব ফুরিয়ে গিয়েচে, এ ভাবটা তার মনে আসতো না যদি একটা অবলম্বন থাকতো জীবনের; কি আঁকড়ে সে। থাকে?
আজ কবছর বড়সাহেব মারা গিয়েচে, নীলকুঠি উঠে গিয়ে নালু পালের জমিদারি কাছারি হয়েচে। এই কবছরেই গয়ামেম নিঃস্ব হয়ে গিয়েচে। বড়সাহেব অনেক গহনা দিয়েচিল, মায়ের অসুখের সময় কিছু, গিয়েচে, বাকি যা ছিল, এতদিন বেচে বন্ধক দিয়ে চলছে। সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
পুরোনো দিনগুলোর কথা যেন স্বপ্ন হয়ে গিয়েচে। অথচ খুব বেশি দিনের কথাও তো নয়। এই তো সে দিনের। কবছর আর হল কুঠি উঠে গিয়েচে। কবছরই বা সাহেব মারা গিয়েচে।
এ কঠিন সংসারে কেউ যে বড় একটা কাউকে দেখে না, তা এতদিনে ভালোই বুঝতে পেরেছে সে। আপনার লোক ছিল যে কজন সব চলে গিয়েচে।
নীরি এসে কাছে বসলো। দোক্তাপান খেয়ে এসেচে, কড়া। দোক্তাপাতার গন্ধ মুখে। ওসব সহ্য করতে পারে না গয়া। ওর গা যেন কেমন করে উঠলো।
–ও গয়া দিদি
–কি রে?
–ঘুমুলি ভাই?
–না, গরমে ঘুম আসচে না।
নীরি খেজুরের চাটাই পেতে ওর পাশেই শুলো। বললে–কি বা খাওয়ালাম তোরে! কখনো আগে আসতিস নে–
এটাও বোধ হয় ঠেস দিয়ে কথা নীরির। সময় পেলে লোকে ছাড়বে। কেন, ব্যাঙের লাথিও খেতে হয়। নীরি তো সম্পর্কে বোন।
গয়া বললে–একটা কথা নীরি। আমার হাত অচল হয়েচে, কিছু নেই। কি করে চালাই বল দিকি?
নীরি সহানুভূতির সুরে বললে–তাই তো দিদি। কি বলি। ধান ভানতি পারবি কি আর? তা হলি পেটের ভাতের চালডা হয়ে যায়। গতর থেকে।
–আমার নিজের ধান তো ভানি। তবে পরের ধান ভানি নি। কি রকম পাওয়া যায়?
–পাঁচাদরে।
–সেটা কি? বোঝলাম না।
–ভারি আমার মেমসায়েব আলেন রে!
সত্যি, গয়ামেম এ কখনো শোনে নি। সে চোদ্দ বছর বয়স থেকে বড় গাছের আওতায় মানুষ। সে এসব দুঃখু-ধান্ধার জিনিসের কোনো খবর রাখে না। বললে–সেডা কি, বুঝলাম না নীরি। বল না?