–একেই বলেচে বৈষ্ণব শাস্ত্রে যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে, তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ ফুরে।
–ঠিক কথা, শুধু একটা মন্দিরে বা তীর্থস্থানে তিনি আছেন? পাগল নাকি! বনস্পতৌ ভূভৃতি নিঝরে বা কূলে সমুদ্রস্য সরিতটে বা সব জায়গায় তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েচেন, অথচ চোখ খুলে না যদি আমি দেখি, তবে তিনি নাচার। তিনি শিশুবেশে এসে আমার গলা দুহাতে জড়িয়ে ভগবান দর্শন হয়? তাঁর হাতের বন্ধনই তো মুক্তি। মুক্তি মুক্তি বলে চিৎকার করলে কি হবে? কি চমৎকার মুক্তি!
–আচ্ছা ভগবান কি আমাদের প্রেম চান বাঁড়ুয্যেমশাই? আপনার কি মনে হয়?
–আজকাল যেন বুঝতে পারি কিছু কিছু। ভগবান প্রেম চান, এটাও মনে হয়। আগে বুঝতাম না। জ্ঞানের ওপরে খুব জোর দিতাম। এখন মনে হয় তিনি আমার বাবা। তাঁর বংশে আমাদের জন্ম। সেই রক্ত গায়ে আছে আমাদের। কখনো কোনো কারণে তিনি আমাদের অকল্যাণের পথে ঠেলে দেবেন না, দিতে পারেন না। তিনি বিজ্ঞ বাবার মতো আমাদের হাত ধরে নিয়ে যাবেন। তিনি যে আমাদের বহু বিজ্ঞ, বহু প্রাচীন, বহু অভিজ্ঞ, বহু জ্ঞানী, বহু শক্তিময় বাবা। আমরা তাঁর নিতান্ত অবোধ, কুসংস্কারগ্রস্ত ভীরু, অসহায় ছেলে। জেনেশুনে কি আমাদের অমঙ্গলের পথে ঠেলে দিতে পারেন? তা কখনো হয়?
রামকানাই উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন–বাঃ, বাঃ
ভবানী বাঁড়ুয্যে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন পরের কথাটা বলতে ইতস্তত করচেন। তারপরে বলেই ফেললেন কথাটা। বললেন–এ আমার নিজের অনুভূতির কথা কবিরাজমশাই। আগে এসব বুঝতাম না, বলেচি আপনাকে। আসল কথা কি জানেন, অপরের মুখে হাজারো কথার চেয়ে নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এককণা সত্যের দাম অনেক বেশি। নিজে বাবা হয়ে, খোকা জন্মাবার পরে তবে ভগবানের পিতৃরূপ নিজের মনে বুঝলাম ভালো করে। এতদিন পিতার মন কি জিনিস কি করে জানবো বলুন!
রামকানাই কবিরাজ হেসে বললেন–তা হলি দাঁড়াচ্চে এই খোকা। আপনার এক গুরু—
–যা বলেন। কে গুরু নয় বলতে পারেন? যার কাছে যা শেখা যায়, সেখানে সে আমার গুরু। তিনি তো সকলের মধ্যেই। একটা গানের মধ্যে আছে না–
জনকরূপেতে জন্মাই সন্তান
জননী হইয়া করি স্তনদান
শিশুরূপে পুনঃ করি স্তনপান
এ সব নিমিত্ত কারণ আমার
–কার গান? বাঃ–
–এও এক নতুন কবির। নামটা বলতে পারলুম না। গোড়াটা হচ্ছে–
আমাতে যে আমি সকলে সে আমি
আমি সে সকল সকলই আমার।
রামকানাই কবিরাজ আতি চমৎকার শ্রোতা। খোকাও তাই। খোকা কেমন একপ্রকার বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে চুপটি করে। রামকানাই উৎসাহের সুরে বললেন– বেশ গান। তবে বড় উঁচু। অদ্বৈত বেদান্ত। ওসব সাধারণের জন্যে নয়।
–আপনি যা বলেন। তবে সত্যের উঁচু নিচু নেই। এ সব গুরুতত্ত্ব। আমার গুরু বলতেন–অদ্বৈতবাদী হওয়া অত সহজ নয়। প্রকৃত অদ্বৈতবাদী জীবের আনন্দকে নিজের আনন্দ বলে ভাববে। জীবের দুঃখ নিজের দুঃখ বলে ভাববে। জীবের সেবায় ভোর হয়ে যাবে। সকলের দেহই তার দেহ, সকলের আত্মাই তার আত্মা। আপন পর কিছু থাকে না সে অবস্থায়। নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে জীবের পায়ে এতটুকু কাঁটা তুলতে। তার কাছে জাগ্রত দশায় অতো মম জগৎ সর্বং, জগতের সবই আমার, সবই আমি–আবার সমাধি অবস্থায় অথবা ন চ কিঞ্চন কিছুই আমার নয়। কিছুই নেই, এক আমিই আছি। জগৎ তখন নেই। বুঝলেন কবিরাজমশাই?
–বড় উঁচু কথা। কিন্তু বড় ভালো কথা। হজম করা শক্ত আমার পক্ষি। বড়ি বেটে রোগ সারাই, আমি ও বেদান্তটেদান্ত কি করবো বলুন? সে মস্তিষ্ক কি আছে? তবে বড় ভালো লাগে। আপনি আসেন এ গরিবের কুঁড়েতে, কত যে আনন্দ দ্যান এসে সে মুখি আর কি বলবো আপনারে? দাঁড়ান, খোকারে কি এটু খেতি দিই। বড় চমৎকার হোলো আজ।
–এই বেশ কথা হচ্ছে, আবার খাওয়া কেন? উঠলেন কেন?
–একটুখানি খেতি দিই ওরে। ছানা দিয়ে গিয়েছিল একটা রুগী। তাই একটু দি–এই নাও ধোকা
খোকা বললে–বাবা না খেলি আমি খাবো না। বাবা আগে খাবে।
রামকানাই হাততালি দিয়ে বললে–বাঃ, ও-ও বাপের বেটা! কেডা গা বাইরি?
ঠিক সেই সময় গয়ামেম এসে ঘরে ঢুকলো, তার হাতে একছড়া কলা, ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁদের প্রণাম করে কলাছড়া এগিয়ে দিয়ে বললে– বাবা খাবেন।
ভবানী ওকে দেখে একটু বিস্মিত হয়েছিলেন। বললেন–এখানে। আস নাকি?
গয়া বিনীত সুরে বললে মাঝে মাঝে বাবার কাছে আসি। তবে আপনার দেখা পাবো এখানে তা ভাবি নি।
–অতদূর থেকে আস কি করে?
–না বাবা, এখানে যেদিন আসি, চরপাড়াতে আমার এক দূর সম্পক্কো বুনের বাড়ি রাতি শুয়ে থাকি।
হঠাৎ তার চোখ গেল কোলে উপবিষ্ট খোকার তন্ময় মূর্তির দিকে। ওর কাছে গিয়ে বললে–এ খোকা কাদের? আপনার? সোনার চাঁদ ছেলেটুকুনি। বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। আহা বেঁচে থাক–দেওয়ানজির বংশের চুড়ো হয়ে বেঁচে থাকো বাবা
ভবানী বললেন–কি কর আজকাল?
–কি আর করব বাবা! দুঃখু-ধান্দা করি। মা মারা যাওয়ার পর বড় কষ্ট। এখানে তাই ছুটে ছুটে আসি বাবার কাছে, একটু চৈতন্যচরিতামৃত শুনতি।
–বল কি! তোমার মুখে যা শুনলাম, অনেক ব্রাহ্মণের মেয়ের মুখে তা শুনি নি!
–সে বাবা আপনাদের দয়া। মা মরে যেতি সংসার বড় ফাঁকা মনে হোলো–তারপর খুব সঙ্কুচিতভাবে নিতান্ত অপরাধিনীর মতো বললে আস্তে আস্তে–বাবা, কাঁচা বয়সে যা করি ফেলিচি, তার চারা নেই। এখন বয়েস হয়েচে, কিছু কিছু বুঝতি পারি; আপনাদের মতো লোকের দয়া একটু পেলি–