ভবানী মনে মনে যা ভাবছিলেন, আহ্নিকের সময়েও ভাবছিলেন, তা হচ্চে এই কালও সাহেব তাঁকে বটতলায় যেতে বলেচে। সাহেবের হুকুম, যেতেই হবে। রাজার মতো ওরা। তিলুকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? অপূর্ব সুন্দরী ও। ওর একটা ছবি যদি সাহেব আঁকে, তবে বড় ভালো হয়। কিন্তু নিয়ে যাওয়াই মুশকিল। যদি কেউ টের পেয়ে যায়–তবে গাঁয়ে শোরগোল উঠবে। একঘরে হতে হবে সমাজে তাঁর শ্যালক রাজারাম রায়কে।
তিলু একখানা রেকাবিতে খাবার নিয়ে এল, নারকেলের সন্দেশ, চিরেভাজা আর মুগতক্তি। হেসে বললে–কেমন! মুগতক্তি যে বড় হয় না এ সময়ে। এখন কি দেবেন তাই বলুন—
নিলু বললে–এখন কান মলে দেবো যে
–দূর! তুই যে কি বলিস কাকে, ছি! ও-কথা বলতে আছে?
বিলু আড়াল থেকে বার হয়ে এসে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ভবানী বিরক্তির সুরে বললে–আর এই এক নষ্টের গোড়া! কি যে সব হাসো! যা-তা মুখে কথাবার্তা তোমাদের দুজনের, বাধে না। ছিঃ
বিলু বললে–অত ছিঃ ছিঃ করতে হবে না বলে দিচ্চি
নিলু বললে–হ্যাঁ। আমরা অত ফেলনা নই যে সর্বদা ছিছিক্কার শুনতে হবে।
তিলু বললে–আপনি কিছু মনে করবেন না। ওরা বড্ড আদুরে আর ছেলেমানুষ–দাদা ওদের কক্ষনো শাসন করতেন না। আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেচেন–
নিলু বললে–হ্যাঁ গো বৃন্দে। তোমাকে আর আমাদের ব্যাখ্যান কতে হবে না, থাক্।
বিলু বললে–দিদি সুয়ো হচ্চে ভাতারের কাছে, বুঝলি না?
ভবানী বললে–ছিঃ ছিঃ, আবার অশ্লীন বাক্য!
বিলু রাগের সুরে বললে–হ্যাঁ গো, সব অশ্লীন বাক্য আর অশ্লীন বাক্য! তবে কি কথা বলবে শুনি? দুটো কথা বলেচো কিনা, অমনি অশ্লীন বাক্য হয়ে গেল। বেশ করবো আমরা অশ্লীন বাক্য বলবো আপনি কি করবেন শুনি?
তিলু ধমকে বললে–যা এখান থেকে। দুজনেই যা। পান নিয়ে এসো।–আর মুগতক্তি দেবো? কেমন লাগলো? বৌদিদি আপনার জন্যে মুগতক্তি রসে ফেলচে। ভাত খাবার সময় দেবে।
–একটা কথা বলি তিলু
–কি?
–কেউ নেই তো এখানে? দেখে এসো।
–না, কেউ নেই। বলুন—
–কাল একবার আমার সঙ্গে বটতলায় যেতে পারবে?
–কেন?
সায়েবকে দিয়ে তোমার ছবি আঁকাবো। ঢাকাই শাড়িখানা পরে যেও। পারবে?
–ও মা!
–কেন কি হয়েচে?
–সে কি হয়? দিনমানে আপনার সঙ্গে কি করে বেরুবো? এই দেখুন আপনার সামনে দিনমানে বার হই বলে কত নিন্দে করচে লোকে। গাঁয়ে সেই রাত্তির ছাড়া দেখা করার নিয়ম নেই। আমাকে বেরুতে হয়। বাধ্য হয়ে, বৌদিদি পেরে ওঠেন না একা সবদিক তাংড়াতে।
–শোনো। ফন্দি করতে হবে। আমাকে যেতে হবে বিকেলে। আজ যে সময় গিয়েছিলুম সে সময়। তুমি নদীর ঘাটে গা ধুতে যেও ঘড়া গামছা নিয়ে। ওখান থেকে নিয়ে যাবো, কেউ টের পাবে না। লক্ষ্মীটি তিলু, আমার বড্ড ইচ্ছে।
–আপনার আজগুবী ইচ্ছে। ওসব চলে কখনো সমাজে? আপনি সন্নিসি হয়ে দেশ-বিদেশ বেড়িয়েছেন বলে সমাজের কোনো খবর তো রাখেন না। আমার যা ইচ্ছে করবার জো নেই।
.
শেষ পর্যন্ত কিন্তু তিলুকে যেতে হল। স্বামীর মনে ব্যথা দেওয়ার কষ্ট সে সইতে পারবে না। ঢাকাই শাড়ি পরে ঘড়া নিয়ে ঘাটের পথ আলো করে যাবার সময় তাকে কেউ দেখে নি, কেবল বাদা বোষ্টমের বৌ ছাড়া।
বোষ্টম-বৌ বললেও দিদিমণি, এ কি, এমন সেজেগুজে কোথায়? রূপে যে ঝলক তুলেচো?
–যাঃ, ঘাটে গা ধোবো। শাড়িখানা কাচবো। তাই
তিলুর বুকের মধ্যে দুরদুর করছিল। অপরাধীর মতো মিথ্যা কৈফিয়তটা খাড়া করলে। ভাগ্যিস যে বোষ্টম-বৌ দাঁড়ালো না, চলে গেল। আর ভাগ্যিস, ঘাটে শেষবেলায় কেউ ছিল না।
গ্র্যান্ট সাহেব দূর থেকে তিলুকে দেখে তাড়াতাড়ি টুপি খুলে সামনে এসে সম্ভ্রমের সুরে বললেন–Oh, she is a queenly beauty! Oh! I am grateful to you, sir, —
তারপর তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তিলুর সলজ্জ মুখের ও অপূর্ব কমনীয় ভঙ্গির একটা আগা রেখাচিত্র আঁকতে চেষ্টা করলেন।
১৮৬৪ সালে প্রকাশিত কোলসওয়ার্দি এ্যান্টের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লাইফ ইন রুরাল বেঙ্গল নামক বইয়ের চুয়ান্ন পৃষ্টায় ও সাতান্ন পৃষ্ঠায় এ বেঙ্গলি উম্যান ও অ্যান ইন্ডিয়ান ইয়োগী ইন্ দি উডস্ নামক দুখানা ছবি যথাক্রমে তিলু ও ভবানী বাঁড়ুয্যের রেখাচিত্র।
গ্রামে কেউ টের পায় নি। মুশকিল ছিল, রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী। এ মাঠ দিয়ে ও মাঠ দিয়ে ঘুরে তিলু স্বামীকে নিয়ে এল; ভবানী বিদেশী লোক, গ্রামের রাস্তাঘাট চিনতেন না। ভজা মুচি সইসকে ভবানী সব খুলে বলে বারণ করে দিয়েচিলেন। তিলু বল্লে–বাবা, কি কাণ্ড আপনার! শিশির পড়চে। ঠাণ্ডা লাগাবেন না। সায়েবটা বেশ দেখতে! আমি এত কাছ থেকে সায়েব কখনো দেখি নি। আপনি একটি ডাকাত।
–ও সব অশ্লীল কথা স্বামীকে বলতে আছে, ছিঃ।–
.
রাজারাম রায়কে ছোটসাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। কেন ডেকে পাঠিয়েছেন রাজারাম তা জানেন। কোনো প্রজার জমিতে জোর করে। নীলের মার্কা মেরে আসতে হবে। রাজারাম দুর্ধর্ষ দেওয়ান, প্রজা কি করে জব্দ করা যায় তাঁকে শেখাতে হবে না। আজ আঠারো বছর এই কুঠিতে তিনি আছেন, বড়সাহেবের প্রিয়পাত্র হয়েচেন শুধু এই প্রজা জব্দ রাখবার দক্ষতার গুণে।
পাচু শেখের বাড়ি তেঘরা শেখহাটি। সেখানকার প্রজারা আপত্তি জানিয়ে বলেচে,দেওয়ানজি, আপনাদের খাসের জমিতে নীল বুনুন, প্রজার জমিতে এবার আমরা নীল বুনতি দেবো না।