ভবানী এ গাছতলায় এর আগে এসেচেন এবং এসব লক্ষ্য করে গিয়েচেন। দু-একটা সন্ধ্যামণির জংলা ফুল ফুটেচে গাছতলায় এখানে ওখানে। ভবানী এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছতলায় গিয়ে চুপচাপ বসলেন। একটু নির্জন জায়গা চাই। চাষীলোকেরা বড় কৌতূহলী, দেখতে পেলে এখানে এসে উঁকিঝুঁকি মারবে আর অনবরত প্রশ্ন। করবে, তিনি কেন এখানে বসে আছেন। তিনি একা বসে রোজ। এ-সময়ে একটু ধ্যান করে থাকেন–তার সন্ন্যাসী-জীবনের বহুদিনের অভ্যাস।
আজও তিনি ধ্যানে বসলেন। একটা সন্ধ্যামণি ফুলগাছের খুব। কাছেই। খানিকটা সময় কেটে গেল। হঠাৎ একটা অপরিচিত ও বিজাতীয় কণ্ঠস্বরে ভবানী চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালেন। একজন সাহেব গাছের গুঁড়ির ওদিকে একটি মোটা ঝুরি ধরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
সাহেবটি আর কেউ নয়, কোলসওয়ার্দি গ্র্যান্ট–তিনি বটগাছের শোভা দূর থেকে দেখে ভালো করে দেখবার জন্যে কাছে এসে আরো আকৃষ্ট হয়ে গাছের তলায় ঢুকে পড়েন এবং এদিক-ওদিক ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ ধ্যানরত ভবানীকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন, An Indian Yogi!
সাহেবের টমটম দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে; সঙ্গে কেউ নেই। ভজা মুচি সহিস টমটমেই বসে আছে ঘোড়া ধরে।
কোলস্ওয়ার্দি গ্র্যান্ট ভবানীর সামনে এসে আশ্বাসের সুরে বললেন Oh, I am very sorry to disturb you. Please go on with your meditations. ভবানী বাঁড়ুয্যে যে কিছুই না বুঝে অবাক হয়ে সাহেবের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি সাহেবকে দুএকদিন এর আগে যে না দেখেছেন এমন নয়, তবে এত কাছে থেকে আর কখনো দেখেন নি।
-I offer you my salutations-I wish I could speak your tongue.
বটতলায় কি একটা ব্যাপার হয়েচে বুঝে ভজা মুচি টমটমের ঘোড়া সামলে ওখানে এসে হাজির হল। সেও ভবানীকে চেনে না। এসে দাঁড়িয়ে বললে–পেরনাম হই বাবাঠাকুর! ও সাহেব ছবি আঁকে কিনা, তাই দেখুন সক্কালবেলা কুঠি থেকে বেরিয়ে মোরে নিয়ে সারাদিন বন বাদাড় ঘোরচে। আপনাকে দেখে ওর ভালো লেগেচে তাই বলচে। ভবানী হাত জুড়ে সাহেবকে নমস্কার করলেন ও একটু হাসলেন।
গ্র্যান্টও দেখাদেখি সেভাবে নমস্কার করবার চেষ্টা করলেন, হল affi Tom-Let me not disturb you–I sincerely regret, I have trespassed into your nice sanctuary. May I have the permission to draw your sketch?–You man, will you make him understand? ভজা মুচিকে গ্র্যান্ট সাহেব হাত পা নেড়ে ছবি আঁকার ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
ভজা মুচি ভবানীর দিকে চেয়ে বলল–ও বলচে আপনার ছবি আঁকবে। মুই জানি কিনা, এই সায়েবটা ওই রকম করে–একটুখানি চুপটি মেরে বসুন–
কি বিপদ। একটু ধ্যান করতে বসতে গিয়ে এ আবার কোন হাঙ্গামা এসে হাজির হল দ্যাখো। কতক্ষণ বসতে হবে? মরুক গে, দেখাই যা রগড়। ভবানী বসেই রইলেন।
গ্র্যান্ট সাহেব ভজা মুচিকে বললেন–Dont you stand agape, just go on and bring my sketching things from the cart
পরে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন–যাও—
এতদিনে ঐ কথাটি গ্র্যান্ট ভালো করে শিখেছেন।
.
দেরি হল বাড়ি ফিরতে, সুতরাং ভবানী নিজের ঘরটিতে ঢুকে দেখলেন তিলু দোরের চৌকাঠে কি একটা নেকড়া দিয়ে পুঁছচে। ভবানী বললেন–কি ওখানে?
তিলু মুখ না তুলেই বললে–রেড়ির তেল পড়ে গেল, পিদিমটা ভাঙ্গলো,–জল পড়লো মেজেতে।
এ-সময়ে সমস্ত পল্লীগ্রামে দোতলা প্রদীপ বা সেজ ব্যবহার হত। তলায় জল থাকতো, ওপরের তলায় তেল। এতে নাকি তেল কম পুড়তো। ভবানী দেখলেন তাঁর খাটের তলায় দোতলা পিদিমটা ছিটকে ভেঙ্গে পড়ে আছে।
–সবই আনাড়ি! ভাঙ্গলে তো পিদিমটা?
–আমি ভাঙ্গি নি।
–কে? নিলু বুঝি?
–আজ্ঞে মশায়, না। চুপ করুন। কথা বলবো না আপনার সঙ্গে।
–কেন, কি করিচি?
–কি করিচি, বটে! আমার কথা শোনা হোলো? সন্দের সময় এসে জল খেতে বলেছিলুম না?
–শোনো, আসবো কি, এক মজা হয়েচে, বলি। কি বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম যে!
তিলু কৌতূহলের দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বললে কি বিপদ? সাপ-টাপ তাড়া করে নি তো? খড়ের কাঠে বড্ড কেউটে সাপের ভয়–
–না গো, সাপ নয়। এক পাগল সাহেব। টমটমের সইস বললে নীলকুটির সাহেবদের বন্ধু, দেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। আমি বটতলায় বসে আছি, আমার সামনে এসে হাঁ করে দাঁড়িয়েছে। কি সব হিট মিট টি বলতে লাগলো। সইসটা বললে–আপনার ছবি আঁকবে–
–ও, সেই ছবি-আঁকিয়ে সায়েব! হ্যাঁ হ্যাঁ, দাদার মুখে শুনেচি বটে। আপনার ছবি আঁকলে?
–আঁকলে বৈ কি। ঠায় বসে থাকতে হোলো চার দণ্ড।
–মাগো।
–এখন বোঝো কার দোষ।
পরক্ষণেই তিলুর দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলেন। কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে!
নিখুঁত সুন্দরী নয় বটে, কিন্তু অপুর্ব রূপ ওর। যেমন হাসি-হাসি মুখ, তেমনি নিটোল বাহুদুটি। গলায় খাঁজকাটা দাগগুলি কি চমৎকার– তেমনি পায়ের রং। সন্দেবেলা দেখাচ্ছে ওকে যেন দেবীমূর্তি।
বললেন–তোমার একটা ছবি আঁকতো সাহেব, তবে বুঝতে যে রূপখানা কাকে বলে।
–যান। আপনি যেন
পরে হেসে বললে–দাড়াঁন, খাবার আনি–সন্দে-আহ্নিকের জায়গা করে দিই?
–হুঁ।
–ও নিলু, শোন ইদিকে–আসনখানা নিয়ে আয়
নিলু এসে আসন পেতে দিলে। গঙ্গাজলের কো-কুশি দিয়ে গেল। তিলু যত্ন করে আঁচল দিয়ে সন্দে-আহ্নিকের জায়গাটা মেজে দিলে।