বাসরঘরে মেয়েরা আমোদ-প্রমোদ করে চলে যাওয়ার পরে ভবানী বাঁড়ুয্যে বললেন–তিলু, তোমার বোনেদের সঙ্গে আলাপ করাও।
তিলোত্তমার গৌরবর্ণ সুঠাম বাহুতে সোনার পৈঁছে, মণিবন্ধে সোনার খাড়, পায়ে গুজরীপঞ্চম, গলায় মুড়কি মাদুলি–লাল চেলি পরনে। পৈঁছে নেড়ে বললে–আপনি ওদের কি চেনেন না?
–তুমি বলে দাও নয়!
–এর নাম স্বরবালা, ওর নাম নীলনয়না।
–আর তোমার নাম কি?
–আমার নাম নেই।
-বলো সত্যি। কি তোমার নাম?
–তি-লো-ও-মা। –বিধাতা বুঝি তিলে তিলে তোমায় গড়েছেন?
তিলু, বিলু ও নিলু একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠলো। তিলু বললে–না গো মশাই, আপনি শাস্তরও ছাই জানেন না
বিলু বললে–বিধাতা পৃথিবীর সব সুন্দরীর
নিলু বললে–রূপের ভালো ভালো অংশ
তিলু বললে–নিয়ে–একটু একটু করে
ভবানী হেসে বললেন–ও বুঝেচি! তিলোত্তমাকে গড়েছিলেন।
তিলু হেসে বললে–আপনি তাও জানেন না।
নিলু ও বিলু একসঙ্গে বলে উঠলো–আমরা আপনার কান মলে দেবো
তিলু বোনেদের দিকে চেয়ে বললেও কি? ছিঃ
বিলু বলে–ছিঃ কেন, আমরা বলবো না? সতীদিদি তো কান মলেই দিয়েছে আজ। দেয় নি?
ভবানী গম্ভীর মুখে বল্লেন–সে হোলো সম্পর্কে শ্যালিকা। তোমরা তো তা নও। তোমরা কি তোমাদের স্বামীর কান মলে দেবার অধিকারী? বুঝেসুজে কথা বলো।
নিলু বললে–আমরা কি, তবে বলুন।
তিলু বোনের দিকে চোখ পাকিয়ে বললে–আবার!
ভবানী হেসে বল্লেন–তোমরা সবাই আমার স্ত্রী। আমার সহধর্মিণী।
বিলু বললে–আপনার বয়েস কত?
ভবানী বললেন–তোমার বয়েস কত?
–আপনি বুড়ো।
তিলু চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে চেয়ে বললে–আবার!
.
ভবানী বাঁড়ুয্যে বাস করবেন রাজারাম-প্রদত্ত জমিতে। ঘরদোর বাঁধবার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েচে, আপাতত তিনি শ্বশুরবাড়িতেই অবিশ্যি। এ এক নূতন জীবন। গিয়েছিলেন সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে, কত তীর্থে তীর্থে ঘুরে এসে শেষে এমন বয়সে কিনা পড়ে গেলেন সংসারের ফাঁদে।
খুব খারাপ লাগছে না। তিলু সত্যি বড় ভালো গৃহিণী, ভবানী ওর কথা চিত্তা করলেই আনন্দ পান। তাকে যেন ও দশ হাত বাড়িয়ে ঘিরে রেখেচে জগদ্ধাত্রীর মতো। এতটুকু অনিয়ম, এতটুকু অসুবিধে হবার জো নেই।
রোজ ভবানী বাঁড়ুয্যে একটু ধ্যান করেন। তাঁর সন্ন্যাসী-জীবনের অভ্যাস এটি, এখনো বজায় রেখেছেন। তিলু বলে দিয়েচে, ঠাণ্ডা লাগবে, সকাল করে ফিরবেন। একদিন ফিরতে দেরি হওয়াতে তিলু ভেবে নাকি অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বিলু নিলু ছেলেমানুষ ভবানী বাঁড়ুয্যের চোখে, ওদের তিনি তত আমল দিতে চান না। কিন্তু তিলুকে পাবার জো নেই।
সেদিন বেরুতে যাচ্চেন ভবানী, নিলু এসে গম্ভীর মুখে বললে– দাঁড়ান ও রসের নাগর, এখন যাওয়া হবে না
–আচ্ছা, ছ্যাবলামি করো কেন বলো তো? আমার বয়েস বুঝে কথা কও নিলু।
–রসের নাগরের আবার রাগ কি!
নিলু চোখ উল্টে কুঁচকে এক অদ্ভুত ভঙ্গি করলে।
ভবানী বললেন–তোমাদের হয়েচে কি জানো? বড়লোক দাদা, খেয়ে-দেয়ে আদরে-গোবরে মানুষ হয়েচো। কর্তব্য-অকর্তব্য কিছু শেখো নি। আমার মনে কষ্ট দেওয়া কি তোমার উচিত? যেমন তুমি, তেমনি বিলু। দুজনেই ধিঙ্গি, ধুরন্ধর। আর দেখ দিকি তোমাদের দিদিকে?
–ধিঙ্গি, ধুরন্ধর–এসব কথা বুঝি খুব ভালো?
–আমি বলতাম না। তোমরাই বলালে।
–বেশ করেচি। আরো বলবো।
–বলো। বলচই তো। তোমাদের মুখে কি বাধে শুনি?
এমন সময়ে তিলু একরাশ কাপড় সাজিমাটি দিয়ে কেচে পুকুরঘাট থেকে ফিরচে দেখা গেল। পেয়ারাতলায় এসে স্বামীর কথার শেষের দিকটা ওর কানে গেল। দাঁড়িয়ে বললে–কি হয়েচে?
ভবানী বাঁড়ুয্যে যেন অকূলে কূল পেলেন। তিলুকে দেখে মনে আনন্দ হয়। ওর সঙ্গে সব ব্যাপারের একটা সুরাহা আছে।
–এই দ্যাখো তোমার বোন আমাকে কি সব অশ্লীল কথা বলচে!
তিলু বুঝতে না পারার সুরে বললে–কি কথা?
–অশ্লীল কথা। যা মুখ দিয়ে বলতে নেই এমনি কথা।
নিলু বলে উঠলো–আচ্ছা দিদি, তুইই বল। পাঁচালির ছড়ায় সেদিন পঞ্চাননতলায় বারোয়ারিতে বলে নি রসের নাগর? আমি তাই বলেছি। দোষটা কি হয়েচে শুনি? বরকে বলবো না?
ভবানী হতাশ হওয়ার সুরে বল্লেন–শোন কথা!
তিলু ছোটবোনের দিকে চেয়ে বললে–তোর বুদ্ধি-সুদ্ধি কবে হবে নিলু?
ভবানী বললেন–ও দুই-ই সমান, বিলুও কম নাকি?
তিলু বললে–না, আপনি রাগ করবেন না। আমি ওদের শাসন করে দিচ্চি। কোথায় বেরুচ্চেন এখন?
–মাঠের দিকে বেড়াতে যাবো।
–বেশিক্ষণ থাকবেন না কিন্তু সন্দের সময় এসে জল খাবেন। আজ বৌদিদি আপনার জন্যে মুগতক্তি করচে
–ভুল কথা। মুগতক্তি এখন হয় না। নতুন মুগের সময় হয়, মাঘ মাসে।
–দেখবেন এখন, হয় কি না। আসবেন সকাল সকাল, আমার মাথার দিব্যি
নিলু বললে–আমারও
তিলু বললে–যা, তুই যা।
.
ভবানী বাড়ির বাইরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। শরৎকাল সমাগত, আউশ ধানের ক্ষেত শূন্য পড়ে আছে ফসল কেটে নেওয়ার দরুন। তিৎপল্লার হলদে ফুল ফুটেছে বনে বনে ঝোপের মাথায়। ভবানীর বেশ লাগে এই মুক্ত প্রসারতা। বাড়ির মধ্যে তিনটি স্ত্রীকে নিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হতে হয়। তার ওপর পরের বাড়ি। যতই ওরা আদর করুক, স্বাধীনতা নেই–ঠিক সময়ে ফিরে আসতে হবে। কেন রে বাবা!
ভবানী অপ্রসন্ন মুখে নদীর ধারে এক বটতলায় গিয়ে বসলেন। বিশাল বটগাছটি, এখানে-সেখানে সব জায়গায় ঝুরি নেমে বড় বড় গুঁড়িতে পরিণত হয়েচে। একটা নিভৃত ছায়াভরা শান্তি বটের তলায়। দেশের পাখি এসে জুটেছে গাছের মাথায়; দুরদুরান্তর থেকে পাখিরা যাতায়াতের পথে এখানে আশ্রয় নেয়, যাযাবর শামকুট, হাঁস ও সিল্লির দল। স্থায়ী বাসস্থান বেঁধেচে খোড়ো হাঁস, বক, চিল, দুচারটি শকুন। ছোট পাখির ঝাঁক–যেমন শালিক, ছাতারে, দোয়েল, জলপিপিএ গাছে বাস করে না বা বসেও না।