ঠিক সেই সময় নালু পাল মোল্লাহাটির হাট থেকে মাথায় মোট নিয়ে ফিরচে। আগের হাটের দিন সে যা লাভ করেছিল, আজ লাভ তার দ্বিগুণ। বেশ চেঁচিয়ে সে গান ধরেছে–
হৃদয়-রাসমন্দিরে দাঁড়া মা ত্রিভঙ্গ হয়ে
এমন সময় পড়ে গেল গ্র্যান্ট সাহেবের সামনে। গ্র্যান্ট সাহেব ডেভিডকে বললেন–লোকটাকে ভালো করে দেখি। একটু থামাও। বাঃ বাঃ, ও কি করে?
ডেভিড সাহেব একেবারে বাঙালি হয়ে গিয়েচে কথাবার্তার ধরনে। ঠিক এ দেশের গ্রাম্য লোকের মতো বাংলা বলে। অনেকদিন এক জায়গাতে আছে। সে মেমসাহেবের দিকে চেয়ে হেসে বললে–He can have his old yew cut down, cant he, madam?
পরে নালু পালের দিকে চেয়ে বললে–বলি ও কর্তা, দাঁড়াও তো দেখি–
নালু পাল আজ একেবারে বাঘের সামনে পড়ে গিয়েচে। তবে ভাগ্যি ভালো, এ হল ছোট সায়েব, লোকটি বড় সায়েবের মতো নয়, মারধর করে না। মেমটা কে? বোধ হয় বড় সায়েবের।
নালু পাল দাঁড়িয়ে পড়ে বললে–আজ্ঞে, সেলাম। কি বলছেন?
–দাঁড়াও ওখানে।
গ্র্যান্ট সাহেব বললেন–ও কি একটু দাঁড়াবে এখানে? আমি একটু ওকে দেখে নিই।
ডেভিড বললে–দাঁড়াও এখানে। তোমাকে দেখে সাহেব ছবি আঁকবে।
গ্র্যান্ট সাহেব বললে–ও কি করে? বেশ লোকটি! খাসা চেহারা চলো যাই।
–ও আমাদের হাটে জিনিস বিক্রি করতে এসেছিল। You wont want him any more?
-No, I want to thank him David. or shall 1–
গ্র্যান্ট সাহেব পকেটে হাত দিতে যেতেই ডেভিড তাড়াতাড়ি নিজের পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে নালু পালের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললে–নাও, সাহেব তোমাকে বকশিশ করলেন–
নালু পাল অবাক হয়ে আধুলিটা ধুলো থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বললে– সেলাম, সায়েব! আমি যেতে পারি?
–যাও।
সুন্দর বিকেল সেদিন নেমেছিল পাঁচপোতার বাঁওড়ের ধারে। বন্যপুষ্প-সুরভিত হয়েছিল ঈষত্তপ্ত বাতাস। রাঙা মেঘের পাহাড় ফুটে উঠেছিল অস্ত-আকাশপটে দূরবিস্তৃত আউশ ধানের সবুজ ক্ষেতের ও-প্রান্তে। কিচ মিচ করছিল গাঙশালিক ও দোয়েল পাখির ঝাঁক। কোলস্ওয়ার্দি গ্র্যান্ট কতক্ষণ একদৃষ্টে অস্তদিগন্তের পানে চেয়ে রইলেন। তাঁর মনে একটি শান্ত গভীর রসের অনুভূতি জেগে উঠলো। বহুদূর নিয়ে যায় সে অনুভূতি মানুষকে। আকাশের বিরাটত্বের সচেতন স্পর্শ আছে সে অনুভূতির মধ্যে। দূরাগত বংশীধ্বনির সুস্বরের মতো করুণ তার আবেদন।
গ্র্যান্ট সাহেব ভাবলেন, এই তো ভারতবর্ষ। এতদিন ঘুরে মরেচেন বোম্বাই, পুনা ক্যান্টমেন্টের পোললা খেলার মাঠে আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ক্লাবে। এরা এক অদ্ভুত জীব। এদেশে এসেই এমন অদ্ভুত জীব হয়ে পড়ে যে কেন এরা! যে ভারতবর্ষের কথা তিনি শকুন্তলা নাটকের মধ্যে পেয়েছিলেন (মনিয়ার উইলিয়ামসের অনুবাদে), যে ভারতবর্ষের খবর পেয়েছিলেন এডুইন আর্নল্ডের কাব্যের মধ্যে, যা দেখতে এতদূরে তিনি এসেছিলেন–এতদিন পরে এই ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদীতীরের অপরাহুটিতে সেই অনিন্দ্যসুন্দর মহাকবিত্বময় সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের সন্ধান পেয়েছেন। সার্থক হল তাঁর ভ্রমণ!
.
রাজারামের ভগ্নী তিনটির বয়স যথাক্রমে ত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ। তিলুর বয়স সবচেয়ে বেশি বটে কিন্তু তিন ভগ্নীর মধ্যে সে-ই সবচেয়ে দেখতে ভালো, এমন কি তাকে সুন্দরী-শ্রেণীর মধ্যে সহজেই ফেলা যায়। রং অবিশ্যি তিন বোনেরই ফর্সা, রাজারাম নিজেও বেশ সুপুরুষ, কিন্তু তিলুর মধ্যে পাকা সবরি কলার মতো একটু লালচে ছোপ থাকায়। উনুনের তাতে কিংবা গরম রৌদ্রে মুখ রাঙা হয়ে উঠলে বড় সুন্দর দেখায় ওকে। তন্বী, সুঠাম, সুকেশী,–বড় বড় চোখ, চমৎকার হাসি। তিলুর দিকে একবার চাইলে হঠাৎ চোখ ফেরানো যায় না। তবে তিলু শান্ত পল্লীবালিকা, ওর চোখে যৌবনচঞ্চল কটাক্ষ নেই, বিয়ে হলে। এতদিন ছেলেমেয়ের মা ত্রিশ বছরের অর্ধপ্রৌঢ়া গিন্নি হয়ে যেত তিলু। বিয়ে না হওয়ার দরুন ওদের তিন বোনেই মনে-প্রাণে এখনো সরলা বালিকা।–আদরে-আবদারে, কথাবার্তায়, ধরন-ধারণে–সব রকমেই।
.
জগদম্বা তিলুকে ডেকে বললেন–চাল কোটার ব্যবস্থা করে ফেলো ঠাকুরঝি।
–তিল?
–দীনু বুড়িকে বলা আছে। সন্দেবেলা দিয়ে যাবে। নিলুকে বলে দাও বরণের ডালা যেন গুছিয়ে রাখে। আমি একা রান্না নিয়েই ব্যস্ত থাকবো।
–তুমি রান্নাঘর ছেড়ে যেও না। যজ্ঞিবাড়ির কাণ্ড। জিনিসপত্তর চুরি যাবে।
তিন বোনে মহাব্যস্ত হয়ে আছে নিজেদের বিয়ের যোগাড় আয়োজনে। ওদের বাড়িতে প্রতিবেশিনীরা যাতায়াত করচেন। গাঙ্গুলীদের মেজবৌ বল্লেও ঠাকুরঝি, বলি আজ যে বড় ব্যস্ত, নিজেরা বাসরঘর সাজিও কিন্তু। বলে দিচ্ছি ও-কাজ আমরা কেউ করবো না। আচ্ছা দিদি, তিলু ঠাকুরঝিকে কি চমৎকার দেখাচ্ছে। বিয়ের জল গায়ে না পড়তেই এই, বিয়ের জল পড়লে নাজানি কত লোকের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেয় আমাদের তিলু-ঠাকুরঝি!
গাঙ্গুলীদের বিধবা ভগ্নী সরস্বতী বললে–বৌদিদির যেমন কথা। মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিতে হয় ওর নিজের সোয়ামীরই ঘোরাবে, অপর কারে আবার খুঁজে বার করতে যাচ্চে ও!
সবাই হেসে উঠলো।
.
পরদিন ভবানী বাঁড়ুয্যের সঙ্গে শুভ গোধূলি-লগ্নে তিন বোনেরই একসঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। হ্যাঁ, পাত্রও সুপুরুষ বটে। বয়স পঞ্চাশই বোধ হয় হবে কিন্তু মাথার চুলে পাক ধরে নি, গৌরবর্ণ সুন্দর সুঠাম সুগঠিত দেহ। দিব্যি একজোড়া গোঁফ। কুস্তগিরের মতো চেহারার বাঁধুনি।