মিঃ গ্র্যান্ট হেসে বললেন–So I beg your pardon, madam!
এই সময় ভজা মুচির দাদা শ্রীরাম মুচি বেয়ারা সাহেবদের জন্যে কফি নিয়ে এল। সাহেবদের চাকর বেয়ারা সবই স্থানীয় মুচি বাগদি প্রভৃতি শ্রেণী থেকে নিযুক্ত হয়। তাদের মধ্যে মুসলমান নেই বললেই হয়, সবই নিম্নবর্ণের হিন্দু। দু-একটি মুসলমান থাকেও অনেক সময়, যেমন এই কুঠিতে মাদার মণ্ডল আছে, ঘোড়ার সহিস।
রাজারাম দাঁড়িয়ে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন। শিপটন বললেন–টুমি যাও ডেওয়ান। টোমাকে ডেখে ইনি ছবি আঁকিটে ইচ্ছা করিটেছেন। টোমাকে আঁকিটে হইবে।
–বেশ হুজুর।
–ডাডন খাটাগুলো একবার ডেখে রাখো।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দপ্তরখানায় কার্যরত রাজারামকে শ্রীরাম মুচি এসে ডাকলে–রায়মশায়, আপনাকে ডাকছে। সেই নতুন সায়েব আপনাকে দেখে ছবি আঁকবে–ওই দেখুন, দুপুরে রোদে নদীর ধারে বিলিতি গাছতলায় কি সব টেঙিয়েছে। গিয়ে দেখুন রগড়! রায়মশায়, বড় সায়েবকে বলে মোরে একটা ট্যাকা দিতে বলুন। ধানের দর বেড়েচে, ট্যাকায় আট কাঠার বেশি ধান দেচ্ছে না। সংসার চলছে না।
–আচ্ছা, দেখবো এখন। বড়সাহেবকে বল্লি হবে না। ডেভিড সাহেবকে বলতি হবে।
রাজারাম রায় বিপন্ন মুখে নদীর ধারে গাছতলায় এসে দাঁড়ালেন। গাছটা হল ইন্ডিয়ান–কর্ক গাছ। শিপটন সাহেবের আগে যিনি বড়সাহেব ছিলেন, তিনি পাটনা জেলার নারাণগড় নীলকুঠিতে প্রথমে ম্যানেজার ছিলেন। শখ করে এই গাছটি সেখান থেকে এনে বাংলার মাটিতে রোপণ করেন। সে আজ পঁচিশ বছর আগেকার কথা। এখন গাছটি খুব বড় হয়েচে, ডালপালা বড় হয়ে নদীর জলে ঝুঁকে পড়েছে। এ অঞ্চলে এ জাতীয় বৃক্ষ অদৃষ্টপূর্ব, সুতরাং জনসাধারণ এর নাম দিয়েচে বিলিতি গাছ।
রাজারাম তো বিলিতি গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। নাঃ, মজা দ্যাখো একবার। এ সব কি কাণ্ড রে বাপু! ওটা আবার কি খাঁটিয়েচে? ব্যাপার কি? রাজারাম হেসে ফেলতেন, কিন্তু শিপটন সাহেবের মেম ওখানে। উপস্থিত। মাগী কি করে এখানে, ভালো বিপদ!
কোলসওয়ার্দি গ্র্যান্ট এক টুকরো রঙিন পেন্সিল হাতে নিয়ে টাঙানো ক্যানভাসের এপাশে ওপাশে গিয়ে দুবার কি দেখলেন। মেমসাহেবকে বললেন–Will he be so good at to stand erect and stand still, say for ten minutes, madam?
মেম বললেন–সোজা হইয়া ডাঁড়াও ডেওয়ান!
–আচ্ছা হুজুর।
রাজারাম কাঁচুমাচু মুখে খাড়া হয়ে পিঠ টান করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেই গ্র্যান্ট সাহেব বললেন–No, no, your Dewan wears a theatrical mask, madam. Will he just stand at ease?
মেমসাহেব হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন–অটখানি লম্বা হয় না। বুক ঠিক করো।
রাজারাম এ অদ্ভুত বাংলার অর্থগ্রহণ করতে না পেরে আরো পিঠ টান করে বুক চিতিয়ে উল্টোদিকে ধনুক করে ফেলবার চেষ্টা করলেন দেহটাকে।
গ্র্যান্ট সাহেব হেসে উঠলেন–oh, no, my good man! This is how–বলে নিজেই রাজারামের কাছে গিয়ে তাকে হাত দিয়ে ঠেলে সামনের দিকে আর একটু ঝুঁকিয়ে সিধে করে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
-I hope to goodness, he will stick to this! Gods death!
তখনি মেমসাহেবের দিকে চেয়ে বললেন–I ask your pardon madam, for my words a moment ago.
মেমসাহেব বললেন–Oh, you wicked man! রাজারাম এবার ঠিক হয়ে দাঁড়ালেন। ছবিওয়ালা সাহেবটা প্রাণ বের করে দিয়েছেন, মেমসাহেবের সামনে, বাবাঃ! আবার ছুঁয়ে দিল! ভেবেছিলেন আজ আর নাইবেন না। কিন্তু নাইতেই হবে। সায়েব টায়েব ওরা স্লেছ, অখাদ্য-কুখাদ্য খায়। না নাইলে ঘরে ঢুকতেই পারবেন না।
ঘণ্টাখানেক পরে তিনি রেহাই পেয়ে বাঁচলেন। বা রে, কি চমৎকার করেচে সাহেবটা! অবিকল তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তবে এখনো মুখ চোখ হয় নি। ওবেলা আবার আসতে বলেচে। আবার ওবেলা ছোঁবে নাকি? অবেলায় তিনি আর নাইতে পারবেন না।
.
কোলসওয়ার্দি গ্র্যান্ট বিকেলে পাঁচপোতার বাঁওড়ের ধারের রাস্তা ধরে বড় টমটমে বেড়াতে বার হলেন। সঙ্গে ছোটসাহেব ডেভিড ও শিপটন সাহেবের মেম। রাস্তাটি সুন্দর ও সোজা। একদিকে স্বচ্ছতোয়া বাঁওড়া আর একদিকে ফাঁকা মাঠ, নীলের ক্ষেত, আউশ ধানের ক্ষেত। গ্র্যান্ট সাহেব শুধু ছবি-আঁকিয়ে নয়, কবি ও লেখকও। তাঁর চোখে পল্লীবাংলার দৃশ্য এক নতুন জগৎ খুলে দিলে। বন্ধনহীন উদাস মাঠের। ফুলভর্তি সোঁদালি গাছের রূপ, ফুলফোঁটা বন-ঝোপে অজানা বনপক্ষীর কাকলি–এসব দেখবার চোখ নেই ওই হাঁদামুখো ডেভিডটার কি গোঁয়ারগোবিন্দ শিপটনের। ওরা এসেছে গ্রাম্য ইংলন্ডের চাষাভুষো। পরিবার থেকে। ওয়েস্টার্ন মিডল্যান্ডের রাই ও ফেয়ারিংফোর্ড গ্রাম। থেকে। এখানে নীলকুঠির বড় ম্যানেজার না হলে ওরা পানটকস্ ম্যানরের জমিদারের অধীনে লাঙল চষতো নিজের নিজের ফার্ম হাউসে। দরিদ্র কালা আদমীদের ওপর এখানে রাজা সেজে বসে আছে। হায় ভগবান! তিনি এসেছেন দেশ দেখতে শুধু নয়, একখানা বই লিখবেন বাংলা দেশের এই জীবন নিয়ে। এখানকার লোকজনের, এই চমৎকার নদীর, এই অজানা বনদৃশ্যের ছবি আঁকবেন সেই বইতে। ইতিমধ্যে সে বইয়ের পরিকল্পনা তাঁর মাথায় এসে গিয়েচে। নাম দেবেন, Anglo-Indian life in Rural Bengal. অনেক মাল-মসলা যোগাড় করে ফেলেছেন।