রাজারাম চিন্তিত মুখে বললেন–বাড়ি থেকে না জিজ্ঞেস করে। কোনো কিছুই বলতে পারবো না কাকা। কাল আপনাকে জানাবো।
–তুমি নির্ভয়ে বিয়ে দাও গিয়ে। আমার ভাগনে বলে বলচি নে। কাটাদ বন্দিঘাটির বারুরি, এক পুরুষে ভঙ্গ, ঘটকের কাছে কুলুজি শুনিয়ে দেবো এখন। জ্বলজ্বলে কুলীন, একডাকে সকলে চেনে।
–বয়েস কতো হবে পাত্তরের?
–তা পঞ্চাশের কাছাকাছি। তোমার বোনদেরও তো বয়েস কম নয়। ভবানী সন্নিসি না হয়ে গেলি এতদিনে সাতছেলের বাপ। দ্যাখো আগে তাকে–নদীর ধারে রোজ এক ঘণ্টা সন্দে-আহ্নিক করে, তারপর আপন মনে বেড়ায়, এই চেহারা! এই হাতের গুল!
–ভবানী রাজি হবেন তিনটি বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করতে?
–সে ব্যবস্থা বাবাজি, আমার হাতে। তুমি নিশ্চিন্দি থাকো।
একটু অন্ধকার হয়েছিল বাঁশবনের পথে। জোনাকি জ্বলছে কচু আর বাবলা গাছের নিবিড়তার মধ্যে। ছাতিম ফুলের গন্ধ ভেসে আসচে বনের দিক থেকে।
.
অনেক রাত্রে তিলোত্তমা কথাটা শুনলে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে নদীর দিকের বাঁশঝাড়ের পেছন দিয়ে। ছোট বোন বিলুকে ডেকে বললেও বিলু, বৌদিদি তোকে কিছু বলেচে?
-বলবে না কেন? বিয়ের কথা তো?
–আ মরণ, পোড়ার মুখ, লজ্জা করে না!
-লজ্জা কি? ধিঙ্গি হয়ে থাকা খুব মানের কাজ ছিল বুঝি?
–তিনজনকেই একক্ষুরে মাথা মুড়তে হবে, তা শুনেচ তো?
–সব জানি।
–রাজি?
–সত্যি কথা যদি বলতে হয়, তবে আমার কথা এই যে হয় তো হয়ে যাক।
–আমারও তাই মত। নিলুর মতটা কাল সকালে নিতে হবে।
–সে আবার কি বলবে, ছেলেমানুষ, আমরা যা করবো সেও তাতে মত দেবেই।
.
তিলু কত রাত পর্যন্ত ছাদে বসে ভাবলে। ত্রিশ বছর তার বয়েস হয়েচে। স্বামীর মুখ দেখা ছিল অস্বপনের স্বপন। এখনো বিশ্বাস হয় না; সত্যিই তার বিয়ে হবে? স্বামীর ঘরে সে যাবে? বোনেদের সঙ্গে, তাই কি? ঘরে ঘরে তো এমনি হচ্চে। চন্দ্ৰকাকার বাপের সতেরোটা বিয়ে ছিল। কুলীন ঘরে অমন হয়েই থাকে। বিয়ের দিন কবে ঠিক করেচে দাদা কে জানে। বরের বয়স পঞ্চাশ তাই কি, সে নিজে কি আর খুকি আছে এখন?
উৎসাহে পড়ে রাত্রে তিলুর ঘুম এল না চক্ষে। কি ভীষণ মশার গুঞ্জন বনে ঝোপে!
তিলু যে সময় ছাদে একা বসে রাত জাগছিল, সে সময় নালু পাল মোল্লাহাটির হাট থেকে ফিরে নিজের হাতে রান্না করে খেয়ে তবিল মিলিয়ে শুয়ে পড়েছে সবে।
নালু এক ফন্দি এনেচে মাথায়।
ব্যবসা কাজ সে খুব ভালো বোঝে এ ধারণা আজই তার হল। সাত টাকা ন আনার পান-সুপুরি বিক্রি হয়েচে আজ। নিট লাভ এক টাকা তিন আনা। খরচের মধ্যে কেবল দুআনার আড়াই সের চাল, আর দুপয়সার গাঙের টাটকা খয়রামাছ একপোয়া। আধসের মাছই নেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু অত মাছ ভাজবার তেল নেই। সর্ষের তেল ইদানীং আক্রা হয়ে পড়েছে বাজারে, তিন আনা সের ছিল, হয়ে দাঁড়িয়েছে চোদ্দ পয়সা; কি করে বেশি তেল খরচ করে সে?
হাতের পুঁজি বাড়াতে হবে। পান-সুপুরি বিক্রি করে উন্নতি হবে না। উন্নতি আছে কাটা কাপড়ের কাজে। মুকুন্দ দে তার বন্ধু, মুকুন্দ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। ত্রিশ টাকা হাতে জমলে সে কাপড়ের ব্যবসা আরম্ভ করে দেবে।
নালু পালের ঘুম চলে গেল। মামার বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে থাকার দায় থেকে সে বেঁচেছে! এখন সে আর ছেলেমানুষ নয়, মামিমার মুখনাড়ার সঙ্গে ভাত হজম করবার বয়েস তার নেই। নিজের মধ্যে সে অদম্য উৎসাহ অনুভব করে। এই ঝিঁঝিপোকার-ডাকে-মুখর জ্যোৎস্নালোকিত ঘুমন্ত রাত্রে অনেক দূর পর্যন্ত যেন সে দেখতে পাচ্চে। জীবনের কত দূরের পথ!
.
রাজারাম সকালে উঠেই ঘোড়া করে নীলকুঠিতে চলে গেলেন। নীলকুঠি যাবার পথটি ছায়াস্নিগ্ধ, বনের লতাপাতায় শ্যামল। যজ্ঞিডুমুর গাছের ডালে পাখির দল ডাকচে কিচকিচ্ করে, জ্যৈষ্ঠের শেষে এখনো ঝাড়-ঝাড় সোঁদালি ফুল মাঠের ধারে।
নীলকুঠির ঘরগুলি ইছামতী নদীর ধারেই। বড় থামওয়ালা সাদা কুঠিটা বড়সাহেব শিপটননের। রাজারাম শিপটননের কুঠির অনেক দূরে ঘোড়া থেকে নেমে ঝাউগাছে ঘোড়া বেঁধে কুঠির সামনে গেলেন, এবং উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে পায়ের জুতোজোড়া খুলে রেখে ঘরের মধ্যে বড় হলে প্রবেশ করলেন।
শিপটন ও তাঁর মেম বাদে আর একজন কে সাহেব হলে বসে আছে! শিপটন বললেন–দেওয়ান এডিকে এসে–Look here, Grant, this is our Dewan Roy
অন্য সাহেবটি আহেলা বিলিতি। নতুন এসেছেন দেশ থেকে। বয়েস ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে, পাদ্রিদের মতো উঁচু কলার পরা, বেশ লম্বা দোহারা গড়ন। এর নাম কোলসওয়ার্দি গ্র্যান্ট, দেশভ্রমণ করতে ভারতবর্ষে এসেছেন। খুব ভালো ছবি আঁকেন এবং বইও লেখেন। সম্প্রতি বাংলার পল্লীগ্রাম সম্বন্ধে বই লিখচেন। মিঃ গ্র্যান্ট মুখ তুলে দেওয়ানের দিকে চেয়ে হেসে বললেন–Yes, he will be a fine subject for my sketch of a Bengalee gentleman, with his turban
শিট সাহেব বললেন–That is a Shamla, not turban
– I would never manage it. Oh!
-You would, with his turban and a good bit of ro guery that he has
– In human nature I believe so far as I can see him-no more.
-All right, all fight-please yourself
মিসেস শিপটন–I am not going to see you fall out with cach other-wicked men that you are!