এত দেরি হওয়ার কারণ এই সন্ধ্যা-গায়ত্রী শেষ করে রাজারাম বিবিধ দেবতার স্তবপাঠ করে থাকেন। দেবদেবীর মধ্যে প্রতিদিন তুষ্ট রাখা উচিত মনে করেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, রক্ষাকালী, সিদ্ধেশ্বরী ও মা মনসাকে। এঁদের কাউকে চটালে চলে না। মন খুঁতখুঁত করে। এঁদের দৌলতে তিনি করে খাচ্ছেন। আবার পাছে কোনো দেবী শুনতে না পান, এজন্যে তিনি স্পষ্টভাবে টেনে টেনে স্তব উচ্চারণ করে থাকেন।
তিলু এসে বললে–দাদা, ডাব খাবে এখন?
–না। মিছরির জল নেই?
-–মিছরি ঘরে নেই দাদা।
–ডাব থাক, তুই জলপান নিয়ে আয়।
তিলু একটা কাঁসার জামবাটিতে মুড়ি ও ছোলাভাজা সর্ষের তেল দিয়ে জবজবে করে মেখে নিয়ে এলো–সে জামবাটিতে অন্তত আধকাঠা মুড়ি ধরে। বিলু নিয়ে এলো একটা কাঁসার থালায় একথালা খাজা কাঁঠালের কোষ। নিলু নিয়ে এলো এক ঘটি জল ও একটা পাথরের বাটিতে আধ পোয়াটাক খেজুর গুড়।
রাজারাম নিলুকে সস্নেহে বললেন–বোস নিলু, কাঁটাল খাবি?
–না দাদা, তুমি খাও। আমি অনেক খেয়েছি।
–বিলু নিবি?
–তুমি খাও দাদা।
জগদম্বা আহ্নিক সেরে এসে কাছে বসলেন–তুমি সারাদিন খেটেপুটে এলে, খাও না জলপান। না খেলে বাঁচবে কিসে? পোড়ারমুখো সায়েবের কুঠিতে তো ভূতোনন্দী খাটুনি।
রাজারাম বললে–কাঁচালঙ্কা নেই? আনতে বলো।
–বাতাস করবো? ও তিলু, তোর ছোট বৌদিদির কাছ থেকে কাঁচালঙ্কা চেয়ে আন–ডালে ধরা গন্ধ বেরুলো কেন দ্যাখো না, ও নেত্যপিসি? ছোট বউ, গিয়ে দ্যাখো তো–
জগদম্বা কাছে বসে বাতাস করতে করতে বলেন–ওগো, জলপান খেয়ে বাইরে যেও না, একটা কথা আছে–
–কি?
–বলচি। ঠাকুরঝিরা চলে যাক।
–চলে গিয়েচে। ব্যাপার কি?
–একটি সুপাত্র এসেচে এই গ্রামে। ঠাকুরঝিদের বিয়ের চেষ্টা দ্যাখো।
–কে বলো তো?
–সন্নিসি হয়ে গিইছিল। বেশ সুপুরুষ। চন্দ্র চাটুয্যের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। সে কাল চলে যাবে শুনচি–একবার যাও সেখানে
–তুমি কি করে জানলে?
–আমাকে দিদি বলে গেলেন যে। দুবার এসেছিলেন আমার কাছে।
–দেখি।
–দেখি বললে চলবে না। তিলুর বয়েস হোলো তিরিশ। বিলুর সাতাশ। এর পরে আর পাত্তর জুটবে কোথা থেকে শুনি? নীলকুঠির কিচিরমিচির একদিন বন্ধ রাখলেও খেতি হবে না।
-তাই যাই তবে। চাদরখানা দ্যাও। তামাক খেয়ে তবে বেরুবো।
চণ্ডীমণ্ডপের সামনে দিয়ে গেলেন না, যাওয়ার উপায় থাকবে না। মহরালি মণ্ডলের সম্পত্তি ভাগের দিন, তিনিই ধার্য করে দিয়েছেন। ওরা এতক্ষণ ঠিক এসে বসে আছে–রমজান, সুকুর, প্রহ্লাদ মণ্ডল, বনমালী মণ্ডল প্রভৃতি মুসলমান পাড়ার মাতব্বর লোকেরা। ও পথে গেলে এখন বেরুতে পারবেন না তিনি।
চন্দ্র চাটুয্যে গ্রামের আর একজন মাতব্বর লোক। সত্তর-বাহাত্তর বিঘে ব্রহ্মোত্তর জমির আয় থেকে ভালোভাবেই সংসার চলে যায়। পাঁচপোতা গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ার কেউই চাকরি করেন না। কিছু না কিছু জমিজমা সকলেরই আছে। সন্ধ্যার পর নিজ নিজ চণ্ডীমণ্ডপে পাশা-দাবার আড্ডায় রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত কাটানো এঁদের দৈনন্দিন অভ্যাস!
চন্দ্র চাটুয্যে রাজারামকে দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা করে বললেন– বাবাজি এসো। মেঘ না চাইতেই জল! আজ কি মনে করে? বোসো বোসো। একহাত হয়ে যাক।
নীলমণি সমাদ্দার বলে উঠলেন–দেওয়ানজি যে, এদিকে এসে মন্ত্রীটা সামলাও তো দাদাভাই–
ফণী চক্কত্তি বললেন–আমার কাছে বোসো ভাই, এখানে এসো। তামাক সাজবো?
রাজারাম হাসিমুথে সকলকেই আপ্যায়িত করে বললেন–বোসো দাদা। চন্দর কাকা, আপনার এখানে দেখচি মস্ত আড্ডা
চন্দ্র চাটুয্যে বললেন–আসো না তো বাবাজি কোনোদিন! আমরা পড়ে আছি একধারে, দ্যাখো না তো চেয়ে।
রাজারাম শতরঞ্চির ওপর পা দিতে না দিতে প্রত্যেকে আগ্রহের সঙ্গে সরে বসে তাঁকে জায়গা করে দিতে উদ্যত হল। নীলমণি সমাদ্দার। অপেক্ষাকৃত হীন অবস্থার গৃহস্থ, সকলের মন রেখে কথা না বললে তাঁর চলে না। তিনি বললেন-দেওয়ানজি আসবে কি ওর চণ্ডীমণ্ডপে। রোজ সন্ধেবেলা কাছারি বসে। আসামী ফরিয়াদীর ভিড় ঠেলে যাওয়া যায় না। ও কি দাবার আড্ডায় আসবার সময় করতে পারে?
ফণী চক্কত্তি বললেন–সে আমরা জানি। তুমি নতুন করে কি শোনালে কথা।
নীলমণি বললেন–দাবায় পাকা হাত। একহাত খেলবে ভায়া?
রাজারাম এগিয়ে এসে হুঁকো নিলেন ফণী চক্কত্তির হাত থেকে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ চন্দ্র চাটুয্যের সামনে তামাক খাবেন না বলে চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরের ঘরে হুঁকো হাতে ঢুকে গেলেন এবং খানিক পরে এসে নীলমণির হাতে হুঁকো দিয়ে পূর্বস্থানে বসলেন।
দাবা খেলা শেষ হল রাত দশটারও বেশি। লোকজন একে একে চলে গেল।
চন্দ্র চাটুয্যেকে রাজারাম তাঁর আগমনের কারণ খুলে বললেন। চন্দ্র চাটুয্যের মুখ উজ্জ্বল দেখালো।
রাজারামের হাত ধরে বললেন–এইজন্য বাবাজির আসা? এ কঠিন কথা কি! কিন্তু একটা কথা বাবা। ভবানী সন্নিসি হয়ে গিইছিল, তোমাকে সে কথাটা আমার বলা দরকার।
–বাড়ি গিয়ে আপনার বৌমাদের কাছে বলি। তিলুকে জানাতে হবে। ওরাই জানাবে—
–বেশ।
পরে সুর নিচু করে বললেন–একটা কথা বলি। ভবানীকে এখানে বাস করাবো এই আমার ইচ্ছে। তুমি গিয়ে তোমার তিনটি বোনের বিয়েই ওর সঙ্গে দ্যাও গিয়ে–বালাই চুকে যাক। পাঁচবিঘে ব্রহ্মোত্তর জমি যতুক দেবে। এখুনি সব ঠিক করে দিচ্চি