তাঁর এক গুরুভ্রাতা পশ্চিমে মির্জাপুরের কাছে কোন পাহাড়ের তলায় আশ্রমে থাকেন। খুব বড় বেদান্তের পণ্ডিত-সন্ন্যাসাশ্রমের নাম চৈতন্যভারতী পরমহংসদেব। আগে নাম ছিল গোপেশ্বর রায়। ভবানীর সঙ্গে অনেকদিন একই টোলে ব্যাকরণ পড়েছেন। তারপর গোপেশ্বর কিছুকাল জমিদারের দপ্তরে কাজ করেন পাটুলি-বলাগড়ের সুপ্রসিদ্ধ রায় বাবুদের এস্টেটে। হঠাৎ কেন সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে চলে যান, সে খবর ভবানী জানেন না, কিন্তু মির্জাপুরের আশ্রমে বসবার পরে ভবানী বাঁড়ুয্যেকে দুচারখানা চিঠি দিতেন।
সেই সন্ন্যাসী গোপেশ্বর তথা চৈতন্যভারতী পরমহংস একদিন এসে হাজির ভবানী বাঁড়ুয্যের বাড়ি। একমুখ আধপাকা আধকাঁচা দাড়ি, গেরুয়া পরনে, চিমটে হাতে, বগলে ক্ষুদ্র বিছানা। তিলু খুব যত্ন আদর করলে। ঘরের মধ্যে থাকবেন না। বাইরে বাঁশতলায় একটা কম্বল বিছিয়ে বসে থাকেন সারাদিন। ভবানী বললেন–পরমহংসদেব, সাপে কামড়াবে। তখন আমায় দোষ দিও না যেন।
চৈতন্যভারতী বলেন–কিছু হবে না ভাই। বেশ আছি।
–কি খাবে?
–সব।
–মাছমাংস?
–কোনো আপত্তি নেই। তবে খাই না আজকাল। পেটে সহ্য হয় না।
–আমার স্ত্রীর হাতে খাবে?
–স্বপাক।
–যা তোমার ইচ্ছে।
তিলুকে কথাটা বলতেই তিলু বিনীতভাবে সন্ন্যাসীর কাছে এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বললে–দাদা
পরমহংস বললেন–কি?
–আপনি আমার হাতের রান্না খাবেন না?
–কারো হাতে খাই নে দিদি। তবে ইচ্ছে হয়ে থাকে বেঁধে দিতে পারো। মাছমাংস কোরো না।
–মাছের ঝোল।
–না।
–কই মাছ, দাদা?
–তুমি দেখচি নাছোড়বান্দা। যা খুশি কর গিয়ে।
সেই থেকে তিলু শুচিশুদ্ধ হয়ে সন্ন্যাসীর রান্না রাঁধে। বিলু-নিলু যত্ন করে খাবার আসন করে তাঁকে খেতে ডাকে। তিন বোনে পরিবেশন। করে ভবানী বাঁড়ুয্যে ও সন্ন্যাসীকে।
.
ইছামতীর ধারে যজ্ঞিডুমুর গাছতলায় সন্ধ্যার দিকে দুজনে বসেছেন। পরমহংস বললেন–হ্যাঁ হে, একে রক্ষা নেই, আবার তিনটি!…
–কুলীনের মেয়ের স্বামী হয় না জানো তো? সমাজে এদের জন্য আমাদের মন কাঁদে। সাধনভজন এ জন্মে না হয় আগামী জন্মে হবে। মানুষের দুঃখ তো ঘোচাই এ জন্মে। কি কষ্ট যে এদেশের কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ের।
–মেয়ে তিনটি বড় ভালো। তোমার খোকাকেও বেশ লাগলো।
–আমার বয়েস হোলো বাহান্ন। ততদিন যদি থাকি, ওকে পণ্ডিত করে যাবো।
তার চেয়ে বড় কাজ–ভক্তি শিক্ষা দিও।
–তুমি বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। ভূতের মুখে রামনাম?
–বৈদান্তিক হওয়া সহজ নয় জেনো। বেদান্তকে ভালো ভাবে বুঝতে হলে আগে ন্যায়মীমাংসা ভালো করে পড়া দরকার। নইলে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় তা বোঝা যায় না। ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করা বড় কষ্টসাধ্য।
–আমাকে পড়াও না দিনকতক?
–দিনকতকের কর্ম নয়। ন্যায় পড়তেই অনেকদিন কেটে যাবে। তুমি ন্যায় পড়, আমি এসে বেদান্ত শিক্ষা দেবো। তবে সাধনা চাই। শুধু পড়লে হবে না। সংসারে জড়িয়ে পড়েচ; ভজন করবে কি করে? এ জন্মে হোলো না।
–কুছ পরোয়া নেই। ওই জন্যেই ভক্তির পথ ধরেচি।
–সেও সহজ কি খুব? জ্ঞানের চেয়েও কঠিন। জ্ঞান স্বাধ্যায় দ্বারা লাভ হয়, ভক্তি তা নয়। মনে ভাব আসা চাই, ভক্তির অধিকারী হওয়া সবচেয়ে কঠিন। কোনোটাই সহজ নয় রে দাদা।
–তবে হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকবো?
–তেষাং সতত যুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বক
–গীতায় বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁতে চিত্ত নিযুক্ত রাখলে তিনিই তাঁকে পাবার বুদ্ধি দান। করেন–দদামি বুদ্ধিযোগং তং–
–তুমিই তো আমার উত্তর দিলে।
–বিয়েটা করে একটু গোলমাল করে ফেলেচো। জড়িয়ে পড়বে। একেবারে তিনটি–একেই রক্ষা থাকে না।
–পরীক্ষা করে দেখি না একটা জীবন। তাঁর কৃপায় দৌড়টাও তো বোঝা যাবে। ভাগবতে শুকদেব বলেচেন–গৃহৈারাসুতৈষনাং গৃহস্থের মতো ভোগ দ্বারা পুত্র স্ত্রী নিয়ে ঘর করবার বাসনা দূর করবে। তাই করচি।
-তা হলে এতকাল পরিব্রাজক হয়ে তীর্থে বেড়ালে কেন? যদি গৃহস্থ সাজবার বাসনাই মনে ছিল তোমার?
–ভেবেছিলাম বাসনা ক্ষয় হয়েচে। পরে দেখলাম রয়েছে। তবে ক্ষয়ই করি। শুকদেবের কথাই বলি–তক্তৈবনাঃ সর্বে যযুধীরাস্তপোবনম সকল বাসনা ত্যাগ করে পরে তপোবনে যাবে। কিন্তু বাসনা থাকতে নয়। সংসার করলে ভগবানকে ডাকতে নেই তাই বা তোমায় কে বলেচে?
–ডাকতে নেই কেউ বলে নি। ডাকা যায় না এই কথাই বলেচে। জ্ঞানও হয় না, ভক্তিও হয় না।
–বেশ দেখবো। ভগবান তোমাদের মতো অত কড়া নয়। অন্তত আমি বিশ্বাস করি না যে সংসারে থাকলে ভক্তি লাভ হয় না। সংসার তবে ভগবান সৃষ্টি করলেন কেন? তিনি প্রতারণা করবেন তাঁর অবোধ সন্তানদের? যারা নিতান্ত অসহায়, তিনি পিতা হয়ে তাদের সামনে ইচ্ছে করে মায়া ফাঁদ পেতেছেন তাদের জালে জড়াবার জন্যে? এর উত্তর দাও।
–এষাবৃতির্ণাম তমোগুণস্য–তমোগুণের শক্তিই আবরণ, বস্তু যথার্থ ভাবে প্রতিভাত না হয়ে অন্য প্রকারে প্রতিভাত হয়–এই জন্যে তমোগুণের নাম বৃতি। ভগবানকে দোষ দিও না। ওভাবে ভগবানকে ভাবছো কেন? বেদান্ত পড়লে বুঝতে পারবে। ওভাবে ভগবান নেই। তিনি কিছুই করেন নি। তোমার দৃষ্টির দোষ। মায়ার একটা শক্তির নাম বিক্ষেপ, এই বিক্ষেপ তোমাকে মোহিত করে রেখে ভগবানকে দেখতে দিচ্ছে না।
–তাঁর শরণাগত হয়ে দেখাই যাক না। তাঁর কৃপার দৌড়টা দেখবো বলিচি তো। মায়াশক্তি-ফক্তি যত বড়ই হোক, তাদের চেয়ে তাঁর শক্তি বড়। মায়াশক্তি কি ভগবান ছাড়া? তাঁর সংসারে সবই তাঁর জিনিস। তিনি ছাড়া আবার মায়া এল কোথা থেকে? গোঁজামিল হয়ে যাচ্চে যে।