হলা পেকে খেতে বসলে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সবাই বলতে লাগলো, বাবা হলধর, ভালো করে খাও।
হলধর অবিশ্যি বলবার আবশ্যক রাখলে না কারো। দুকাঠা চালের ভাত, দুহাঁড়ি কলাইয়ের ডাল, একহাঁড়ি পায়েস, আঠারো গণ্ডা নারকেলের নাড়, একখোরা অম্বল আর দুঘটি জল খেয়ে সে ভোজন পর্ব সমাধা করলে।
তারপর বললে–খোকার মুখ দেখবো।
তিলু শুনে ভয় পেয়ে বললে–ওমা, ও খুনে ডাকাত, ওর সামনে খোকারে বার করবো না আমি!
শেষ পর্যন্ত ভবানী বাঁড়ুয্যে যে নিজে খোকাকে কোলে নিয়ে হলা পেকের কোলে তুলে দিতেই সে গাঁট থেকে একছড়া সোনার হার বের করে খোকার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললে–আমার আর কিছু নেই দাদা-ভাই, এ ছেল, তোমারে দিলাম। নারায়ণের সেবা হোলো আমার!
ভবানী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে হারছড়ার দিকে চেয়ে বললেন–না, এ হার তুমি দিও না। দামি জিনিসটা কেন দেবে? বরং কিছু মিষ্টি কিনে দাও–
হলা পেকে হেসে বললে–বাবাঠাকুর, আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। এ লুটের মাল নয়। আমার ঘরের মানুষের গলার হার ছেল, তিনি। স্বগৃগে গিয়েচে আজ বাইশ-তেইশ বছর। আমার ভিটেতে ভাঁড়ের মধ্যে পোঁতা ছেল। কাল এরে তুলে তেঁতুল দিয়ে মেজেচি। অনেক পাপ করেছি জীবনে। ব্রাহ্মণকে আমি মানি নে বাবাঠাকুর। সব দুষ্ট্র। খোকাঠাকুর নিষ্পাপ নারায়ণ। ওর গলায় হার পরিয়ে আমার পরকালের কাজ হোলো; আশীর্বাদ করুন।
উপস্থিত সকলে খুব বাহবা দিলে হলা পেকেকে। ভবানী নিজেকে বিপন্ন বোধ করলেন বড়। তিলুকে নিয়ে এসে দেখাতে তিলু ও বললে–এ আপনি ওকে ফেরত দিন। খোকনের গলায় ও দিতি মন। সরে না।
–নেবে না। বলি নি ভাবচো? মনে কষ্ট পাবে। হাত জোড় করে বললে।
–বলুক গে। আপনি ফেরত দিয়ে আসুন।
–সে আর হয় না, যতই পাপী হোক, নত হয়ে যখন মাপ চায়, নিজের ভুল বুঝতে পারে, তার ওপর রাগ করি কি করে? না হয় এরপর হার ভেঙ্গে সোনা গলিয়ে কোনো সৎকাজে দান করলেই হবে।
তিলু আর কোনো প্রতিবাদ করলে না। কিন্তু তার মুখ দেখে মনে। হল সে মন খুলে সায় দিচ্ছে না এ প্রস্তাবে।
হলা পেকে সেই দিনটি থেকে রোজ আসতে আরম্ভ করলে ভবানী বাঁড়ুয্যের কাছে। কোনো কথা বলে না, শুধু একবার খোকনকে ডেকে দেখে চলে যায়।
একদিন ভবানী বললেন–শোনো হে, বোসো—
সামান্য বৃষ্টি হয়েচে বিকেলে। ভিজে বাতাসে বকুল ফুলের সুগন্ধ। হলা পেকে এসে বসে নিজের হাতে তামাক সেজে ভবানী বাঁড়ুয্যেকে দিলে। এখানে সে যখনই এসে বসে, তখন যেন সে অন্যরকম লোক হয়ে যায়। নিজের মুখে নিজের কৃত নানা অপরাধের কথা বলে কিন্তু। গর্বের সুরে নয়, একটি ক্ষীণ অনুতাপের সুর বরং ধরা পড়ে ওর কথার মধ্যে।
–বাবাঠাকুর, যা করে ফেলিচি তার আর কি করবো। সেবার গোসাঁই বাড়ির দোতলায় ওঠলাম বাঁশ দিয়ে। ছাদে উঠি দেখি স্বামী স্ত্রী শুয়ে আছে। স্বামী তেমনি জোয়ান, আমারে মারতি এলো বর্শা তুলে। মারলাম লাঠি ছুঁড়ে, মেয়েটা আগে মলো। স্বামী ঘুরে পড়লো, মুখি থান-থান রক্ত উঠতি লাগলো। দুজনেই সাবাড়।
-বলো কি?
-হ্যাঁ বাবাঠাকুর। যা করে ফেলিচি তা বলতি দোষ কি? তখন যৈবন বয়েস ছেল, তাতে বোঝতাম না। এখন বুঝতি পেরে কষ্ট পাই মনে।
–রণ-পা চড়ো কেমন? কতদূর যাও?
–এখন আর তত চড়িনে। সেবার হলুদপুকুরি ঘোষেদের বাড়ি লুঠ করে রাতদুপুরির সময় রণ-পা চড়িয়ে বেরোলাম। ভোরের আগে নিজের গাঁয়ে ফিরেলাম। এগারো কোশ রাস্তা।
–ওর চেয়ে বেশি যাও না?
–একবার পনেরো কোশ পজ্জন্ত গিইলাম। নদীপুর থেকে কামারর্পেড়ে। মুরশিদ মোড়লের গোলাবাড়ি।
–এইবার ওসব ছেড়ে দাও। ভগবানের নাম করো।
-তাই তো আপনার কাছে যাতায়াত করি বাবাঠাকুর, আপনাকে দেখে কেমন হয়েচে জানি নে। মনডা কেমন করে ওঠে আপনাকে দেখলি। একটা উপায় হবেই আপনার এখানে এলি, মনডা বলে।
–উপায় হবে। অন্যায় কাজ একেবারে ছেড়ে না দিলে কিন্তু কিছুই করতে পারা যাবে না বলে দিচ্চি।
হলা পেকে হঠাৎ ভবানী বাঁড়ুয্যের পা ছুঁয়ে বললে–আপনার দয়া, বাবাঠাকুর। আপনার আশীৰ্বাদে হলধর যমকেও ডরায় না। রণ-পা চড়িয়ে যমের মুণ্ডু কেটে আনতি পারি, যেমন সেবার এনেলাম ঘোড়ের ডাঙ্গায় তুষ্ট্র কোলের মুণ্ডু–শোনবেন সে গল্প
হলা পেকে অট্টহাস্য করে উঠলো।
ভবানী বাঁড়ুয্যে দেখতে পেলেন পরকালের ভয়ে কাতর ভীরু হলধর ঘোষকে নয়, নির্ভীক, দুর্জয়, অমিততেজ হলা পেকেকে–যে মানুষের মুণ্ডু নিয়ে খেলা করেচে যেমন কিনা ছেলেপিলেরা খেলে পিটুলির ফল নিয়ে! এ বিশালকায়, বিশালভুজ হলা পেকে মোহমুরের শ্লোক শুনবার জন্যে তৈরি নেই–নরহন্তা দস্যু আসলে যা তাই আছে।
.
ভবানী বাঁড়ুয্যে দেড় বছরের মধ্যেই এ গ্রামকে, এ অঞ্চলকে বড় ভালবাসলেন। এমন ছায়াবহুল দেশ তিনি কোথাও দেখেন নি। জীবনে। বৈঁচি, বাঁশ, নিম, সোঁদাল, রড়া, কুঁচলতার বনঝোপ। দিনে রাতে শালিখ, দোয়েল, ছাতারে আর বৌ-কথা-কও পাখির কাকলি। ঋতুতে ঋতুতে কত কি বনফুলের সমাবেশ। কোনো মাসেই ফুল বাদ যায় না–বনে বনে ধুন্দুলের ফুল, রাধালতার ফুল, কেয়া, বিপুষ্প, আমের বউল, বকুল, সুয়ো, বনচকা, নাটাকাঁটার ফুল।
ইছামতীর ধারে এদেশে লোকের বাস নেই, নদীর ধারে বনঝোপের সমাবেশ খুব বেশি। ভবানী বাঁড়ুয্যে একটি সাধন কুটির নির্মাণ করে সাধনভজন করবেন, বিবাহের সময় থেকেই এ ইচ্ছা তাঁর ছিল। কিন্তু ইছামতীর ধারে অধিকাংশ জমি চাষের সময় নীলকুঠির আমিনে নীলের চাষের জন্য চিহ্নিত করে যায়। খালি জমি পাওয়া কঠিন। ভবানী বাঁড়ুয্যেও আদৌ বৈষয়িক নন, ওসব জমিজমার হাঙ্গামে জড়ানোর চেয়ে নিস্তব্ধ বিকেলে দিব্যি নির্জনে গাঙের ধারে এক যজ্ঞিডুমুর গাছের ছায়ায় বসে থাকেন। বেশ কাজ চলে যাচ্চে। জীবন কদিন? কেন বা ওসব ঝাটের মধ্যে গিয়ে পড়বেন। ভালোই আছেন।