–সব ঝামেলা পোয়াবো আমি। আপনাকে কিছু ভাবতি হবে না।
–যা বোঝো করো। খরচ কেমন হবে?
–চালডাল আনবো বাপের বাড়ি থেকে। দুটাকার তরকারি একগাড়ি হবে। পাঁচখানা গুড় পাঁচসিকে। আধ মন দুধ এক টাকা। এক মন। মাছ বারো পনের টাকা। আবার কি?
–কত লোক খাবে?
–দুশো লোক খাবে ওর মধ্যে। আমার হিসেব আছে। দাদার লোকজন খাওয়ানোর বাতিক আছে, বছরে যভিজ্ঞ লেগেই আছে আমাদের বাড়ি। তিরিশ টাকার ওপর যাবে না।
–তুমি তো বলে খালাস। তিরিশ টাকা সোজা টাকা! তোমার কি, বড় মানুষের মেয়ে। দিব্যি বলে বসলে।
তিলু রাগভরে ঘাড় বাঁকিয়ে বললে–আমি শুনবো না, দিতিই হবে খোকার ভাত।
নিলু কোথা থেকে এসে বললে–দেবেন না ভাত? তবে বিয়ে করবার শখ হয়েছিল কেন?
ভবানী তিরস্কারের সুরে বললেন–তুমি কেন এখানে? আমাদের কথা হচ্ছে—
নিলু বললে–আমারও বুঝি ছেলে নয়?
–বেশ। তাই কি?
–তাই এই–খোকনের ভাত দিতে হবে সামনের দিনে।
.
ভবানী বাঁড়ুয্যের নবজাত পুত্রটির অন্নপ্রাশন। তিলু রাত্রে নাড় তৈরি করলে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে পুরো পাঁচ ঝুড়ি। খোকা দেখতে খুব সুন্দর হয়েচে, যে দেখে সে-ই ভালবাসে। তিলু খোকার জন্য একছড়া সোনার হার গড়িয়ে দিয়েছে দাদাকে বলে। রাজারাম নিজের হাতে সোনার হারছড়া ভাগ্নের গলায় পরিয়ে দিলেন।
তিলুদের অবস্থা এমন কিছু নয়, তবুও গ্রামের কাউকে ভবানী বাঁড়ুয্যে বাদ দিলেন না। আগের দিন পাড়ার মেয়েরা এসে পর্বতপ্রমাণ তরকারি কুটতে বসলো। সারারাত জেগে সবাই মাছ কাটলে ও ভাজলে।
গ্রামের কুসী ঠাকরুণ ওস্তাদ রাঁধুনী, শেষরাতে এসে তিনি রান্না চাপালেন, মুখুয্যেদের বিধবা বৌ ও নঠাকরুণ তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন।
ভাত রান্না হল কিন্তু বাইরে বান কেটে। আর ছিরু রায় এবং হরি নাপিত বাকি মাছ কুটে ঝুড়ি করে বাইরের বানে নিয়ে এল মাছ ভাজিয়ে নিতে। ভাত যারা রান্না করছিল, তারা হাঁকিয়ে দিয়ে বললে– এখন তাদের সময় নেই। নিজেরা বান কেটে মাছ ভাজুক গিয়ে। এই কথা নিয়ে দুই দলে ঘোর তর্ক ও ঝগড়া, বৃদ্ধ বীরেশ্বর চক্কত্তি এসে দুদলের ঝগড়া মিটিয়ে দিলেন শেষে।
রাজারামের এক দূরসম্পর্কের ভাইপো সম্প্রতি কলকাতা থেকে এসেচে। সেখানে সে আমুটি কোম্পানীর কুঠিতে নকলনবিশ। গলায় পৈতে মালার মতো জড়িয়ে রাঙা গামছা কাঁধে সে রান্নার তদারক করে বেড়াচ্ছিল। বড় চালের কথাবার্তা বলে। হাত পা নেড়ে গল্প করছিল–কলকাতায় একরকম তেল উঠেচে, সাহেবরা জ্বালায়, তাঁকে মেটে তেল বলে। সায়েবরা জ্বালায় বাতিতে। বড় দুর্গন্ধ।
রূপচাঁদ মুখুয্যে বললেন-পিদিম জ্বলে?
–না। সায়েব বাড়ীর বাতিতে জ্বলে। কাচ বসানো, সে এখানে কে আনবে? অনেক দাম।
হরি রায় বললেন–আমাদের কাছে কলকেতা কলকেতা করো না। কলকেতায় যা আছে তা আগে আসবে আমাদের নীলকুঠিতে। এদের মতো সায়েব কলকেতায় নেই।
–নাঃ নেই! কলকাতায় কি দেখেছ তুমি? কখনো গেলে না তো। নৌকো করে চলো নিয়ে যাবো।
–আচ্ছা নাকি কলের গাড়ী উঠেচে সায়েবদের দেশে? নীলকুঠির নদেরচাঁদ মণ্ডল শুনেচে ছোটসায়েবের মুখে। ওদের দেশ থেকে নাকি কাগজে ছেপে ছবি পাঠিয়েছে। কলের গাড়ি।
ভবানী বাঁড়ুয্যে খোকাকে কোলে নিয়ে পাড়া প্রদক্ষিণ করতে চললেন, পেছনে পেছনে স্বয়ং রাজারাম চললেন ফুল আর খই ছড়াতে ছড়াতে। দীনু মুচি ঢোল বাজাতে বাজাতে চললো। বাঁশি বাজাতে বাজাতে চললো তার ছেলে। রায়পাড়া, ঘোষপাড়া, ও পুবেরপাড়া ঘুরে এলেন ভবানী বাঁড়ুয্যে অতটুকু শিশুকে কোলে করে নিয়ে। বাড়ী বাড়ী শাঁখ বাজতে লাগলো। মেয়েরা ঝুঁকে দেখতে এল খোকাকে।
ব্রাহ্মণভোজনের সময় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা হতে লাগলো। কে কত কলাইয়ের ডাল খেতে পারে। কে কত মাছ খেতে পারে। মিষ্টি শুধু নারকোল নাড়। খেতে বসে অনেকে বললেন এমন নারকোলের নাড়ু তাঁরা অনেককাল খান নি। অন্য কোন মিষ্টির রেওয়াজ ছিল না দেশে। এক একজন লোক সাত আট গণ্ডা নারকোল নাড়ু, আরো অতগুলো অন্নপ্রাশনের জন্য ভাজা আনন্দনা উড়িয়ে দিলে অনায়াসে।
ব্রাহ্মণভোজন প্রায় শেষ হয়েচে এমন সময় কুখ্যাত হলা পেকে বাড়ীতে ঢুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে ভবানী বাঁড়ুয্যেকে। ভবানী ওকে চিনতেন না, নবাগত লোক এ গ্রামে। অন্য সকলে তাকে খুব খাতির করতে লাগলো। রাজারাম বললেন–এসো বাবা হলধর, বাবা বসো
ফণি চক্কত্তি বললেন–বাবা হলধর, শরীর-গতিক ভালো?
দুর্দান্ত ডাকাতের সর্দার, রণ-পা পরে চল্লিশ ক্রোশ রাস্তা রাতারাতি পার হওয়ার ওস্তাদ, অগুনতি নরহত্যাকারী ও লুঠেরা, সম্প্রতি জেলফেরৎ হলা পেকে সবিনয়ে হাতজোড় করে বললে–আপনাদের ছিচরণের আশীব্বাদে বাবাঠাকুর–
–কবে এলে?
–এ্যালাম শনিবার বেনবেলা বাবাঠাকুর। আজ এখানে দুটো পেরসাদ পাবো ব্রাহ্মণের পাতের
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবা বোসো।
হলা পেকে নীলকুঠির কোর্টের বিচারে ডাকাতির অপরাধে তিন বৎসর জেলে প্রেরিত হয়েছিল। গ্রামের লোকে সভয়ে দেখলে সে খালাস পেয়ে ফিরেচে। ওর চেহারা দেখবার মত বটে। যেমন লম্বা তেমনি কালো দশাসই সাজোয়ান পুরুষ, একহাতে বন্ধ করে টেকি ঘোরাতে পারে, অমন লাঠির ওস্তাদ এদেশে নেই–একেবারে নির্ভীক নীলকুঠির মুডি সাহেবের টমটম গাড়ী উল্টে দিয়েচিল ঘোড়ামারির মাঠের ধারে। তবে ভরসা এই দেবদ্বিজে নাকি ওর অগাধ ভক্তি, ব্রাহ্মণের বাড়ী সে ডাকাতি করেছে বলে শোনা যায় নি, যদিও এ-কথায় খুব বেশী ভরসা পান না এ অঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা।