তিলু বললে–এত রাত করলেন আজ! ভাত জুড়িয়ে গেল। নিলু ইদিকি আয়, জায়গা করে দে–বিলু কোথায়?
নিলু চোখ মুছতে মুছতে এল। রান্নাঘরের দাওয়া ঝাঁট দিতে দিতে। বললে–বিলু ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথায় ছিলেন নাগর এত রাত অবধি? নতুন কিছু জুটলো কোথাও?
ভবানী বাঁড়ুয্যে অপ্রসন্ন মুখে বললেন–তোমার কেবল যতো–
-হি হি হি
–হ্যাঁ-হাসলেই মিটে গেল।
–কি করতি হবে শুনি তবে।
দ্যাখো গে লোকে কি করচে। মানুষ হয়ে জন্মে আর কিছু করবে না ? শুধু খাবে আর বাজে বকবে?
–ওগো অত উপদেশ দিতি হবে না আপনার। আপনি পরকালের ইহকালের সর্বস্ব আমাদের। আর কিছু করতি হয়, সে আপনি করুন গিয়ে। আমরা ডুমুরের ডালনা দিয়ে ভাত খাবো আর আপনার সঙ্গে ঝগড়া করবো। এতিই আমাদের স্বগৃগো। খেয়ে উঠে খোকাকে ধরুন।
ভবানী খেয়ে উঠে খোকনকে আদর করলেন কতক্ষণ ধরে। আট মাসের সুন্দর শিশু। তিলুর খোকা। সে হাবলার মতো বিস্ময়ের দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর অকারণে একগাল হাসি হাসে দন্তবিহীন মুখে, বলে ওঠে—গ-গ-গ-গ
ভবানী বলেন–ঠিক ঠিক।
–হেঁ-এ-এ-ইয়া। গ-গ-গ-গ-।
–ঠিক বাবা।
খোকা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে নিজের হাতখানা নিজের চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে–যেন কত আশ্চর্য জিনিস। ভবানীর সামনে অনন্ত আকাশের এক ফালি। বাঁশবনে জোনাকি জ্বলচে। অন্ধকারে পাকা ফুলের গন্ধের সঙ্গে বনমালতী ও ঘেঁটকোল ফুলের গন্ধ। নক্ষত্র উঠেচে এখানে ওখানে আকাশে। কত বড় আকাশ, কত নক্ষত্র– চাঁদ উঠেচে কৃষ্ণা তৃতীয়ার, পূর্ব দিগন্ত আলো হয়েচে। এই ফুল, এই অন্ধকার, এই অবোধ শিশু, এই নক্ষত্র-ওঠা-আকাশ সবই এক হাতের তৈরি বড় ছবি। ভবানী অবাক হয়ে যান ওর খোকার মতোই।
.
তিলু বললে–খোকনের ভাত দেবেন কবে?
–ভাত হবে উপনয়নের সময়।
–ওমা, সে আবার কি কথা! তা হয় না, আপনি অন্নপ্রাশনের দিনক্ষ্যাণ দেখুন। ও বললি চলবে না।
–তোমাদের বাঙাল দেশে এক রকম, আমাদের আর এক রকম। ওসব চলবে না আমাদের নদে-শান্তিপুরের সমাজে। তুমি ওকে একটু আদর কর দিকি?
তিলু তার সুন্দর মুখোনি খোকনের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে কানের। মাকড়ি দুলিয়ে দুলিয়ে অনবদ্য ভঙ্গিতে আদর করতে লাগলো–ও খোকন, ও সনলু, তুমি কার খোকন? তুমি কার সলু, কার মানকু? সঙ্গে সঙ্গে খোকা মায়ের চুল ক্ষুদ্র একরক্তি হাতের মুঠো দিয়ে অক্ষম আকর্ষণে টেনে এনে, মায়ের মাথার লুটন্ত কালো চুলের কয়েক গাছি নিজের মুখের কাছে এনে খাবার চেষ্টা করলে। তারপর দন্তবিহীন একগাল হাসি হাসলে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে।
ভবানী বাঁড়ুয্যে একবার আকাশের দিকে চাইলেন, নক্ষত্রখচিত অনন্ত আকাশ–নিচে এই মা ও ছেলের ছবি। অমনি স্নেহময়ী মা আছেন এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে, নইলে এই মা, এই স্নেহ এখানে থাকতো না–ভবানী বাঁড়ুয্যে ভাবেন।
ভবানী কত পথে পথে বেড়িয়েচেন, কত পর্বতে সাধু-সন্নিসির খোঁজ করেচেন, কত যোগাভ্যাস করেচেন, আজকাল এই মা-ছেলের গভীর যোগাযোগের কাছে তাঁর সকল যোগ ভেসে গিয়েচে। অনুভুতি সর্বাশ্রয়ী, সর্বমঙ্গলকর সে অনুভূতির দ্বারপথে বিশ্বের রহস্য যেন সবটা চোখে পড়লো। ক্ষণশাশ্বতীর অমরত্ব আসা-যাওয়ার পথের এই রেখাই যুগে যুগে কবি, ঋষি ও মরমী সাধকেরা খোঁজেন নি কি?
তিনি আছেন তাই এই যা আছে, ছেলে আছে, ফুল আছে, স্নেহ আছে, আত্মত্যাগ আছে, সেবা আছে, প্রেমিকা আছে, প্রেমিক আছে।
ভবানীর মনে আছে তিনি একবার কানপুরে একজন প্রসিদ্ধ খেয়াল গায়কের গান শুনেছিলেন, তাঁর নাম ছিল কানহাইয়া লাল সান্তারা, প্রসিদ্ধ গায়ক হনুমানদাসজীর তিনি ছিলেন গুরুভাই। আস্থায়ীর বাণীটি শ্রোতাদের সামনে নিখুঁত পাকা সুরে শুনিয়ে নিয়ে তারপর এমন সুন্দর অলঙ্কার সৃষ্টি করতেন, এমন মধুর সুরলহরী ভেসে আসতো। তাঁর কণ্ঠ থেকে সুরপুরের বীণানিক্কণের মতো–যে কতকাল আগে শুনলেও আজও যখনি চোখ বোজেন ভবানী শুনতে পান ত্রিশ বছর আগে শোনা সেই অপূর্ব দরবারি কানাড়ার সুরপুঞ্জ।
বড় শিল্পী সবার অলক্ষ্যে কখন যে মনোহরণ করেন, কখন তাঁর অমর বাণী দরদের সঙ্গে প্রবেশ করিয়ে দেন মানুষের অন্তরতম অন্তরটিতে!
ভবানী বিস্মিত হয়ে উঠলেন। এই মা ও শিশুর মধ্যেও সেই অমর। শিল্পীর বাণী, অন্য ভাষায় লেখা আছে। কেউ পড়তে পারে, কেউ পারে না।
বাইরে বাঁশগাছে রাতচরা কি পাখি ডাকচে, জিউল গাছের বউলের মধু খেতে যাচ্ছে পাখিটা। জেলেরা আলোয় মাছ ধরছে বাঁওড়ে, ঠকঠক শব্দ হচ্ছে তার। আলোয় মাছ ধরতে হলে নৌকার ওপর ঠকঠক শব্দ করতে হয়–এ ভবানী বাঁড়ুয্যে এদেশে এসে দেখছেন। বেশ দেশ। ইছামতীর স্নিগ্ধ জলধারা তাঁর মনের ওপরকার কত ময়লা ধুয়ে মুছে দিয়েছে। সংসারের রহস্য যারা প্রত্যক্ষ করতে ইচ্ছে করে, তারা চোখ খুলে যেন বেড়ায় সব সময়। সংসার বর্জন করে নয়, সংসারে থেকেই সেই দৃষ্টি লাভ করতে পারার মন্ত্র ইছামতী যেন তাকে দান করে। কলম্বনা অমৃতধারাবাহিনী ইছামতী!…যে বাণী মনে নতুন আশা আনন্দ আনে না, সে আবার কোন্ ঈশ্বরের বাণী?
তিলু বললে–সত্যি বলুন, কবে ভাত দেবেন?
–তুমিও যেমন, আমরা গরিব। তোমার বাপের বাড়ির মান বজায় রেখে দিতে গেলে কত লোককে নেমন্তন করতে হবে। সে এক হৈ-হৈ কাণ্ড হবে। আমি ঝামেলা পছন্দ করি নে।