-বকচিই তো। ধাড়ী মোষ, সংসারে কাজ নেই–এত সকালে ঘুম কেন?
–বেশ করবো।
–যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা–আ মোলো যা–
–গাল দিও না দাদা বলে দিচ্ছি। তোমার খাই না পরি?
–তবে কার খাস পরিস, ও পোড়ারমুখী?
–মার।
–মা তোমাকে এনে দেয় রোজগার করে! বাঁদূরি কোথাকার, ধুচুনি মাথায় দোজবরে বুড়ো বর যদি তোর না আনি–
–ইস বুঁটি দিয়ে নাক কেটে দেবো না বুড়ো বরের? হাঁ দাদা, তুমি আমাদের বৌদিদিকে কবে আনচো?
–তোমায় আগে পার করি। তবে সে কথা। তোমার মতো খাণ্ডার ননদকে বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে
–আহা হা! কথার কি ছিরি! খাণ্ডার ননদ দেখো তখন বৌদিদির কত কাজ করে দেবে। আমার পালকি কই?
–পালকি পাই নি। পোড়ানো থাকে না তো। পুরো পোটোকে বলে রেখেছি। রথের সময় রং করে দেবে।
–পুতুলের বিয়ে দেব আষাঢ় মাসে। তার আগে কিনে দিতে হবে পালকি। না যদি দাও তবে–
–যা যা, তামাক সেজে আন। বাজে বকুনি রেখে দে।
ময়না তামাক সেজে এনে দিল। অল্প কয়েক টান দিয়েই নালু পাল একটা মাদুর দাওয়ায় টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো।
গ্রীষ্মকাল। আতা ফুলের সুমিষ্ট গন্ধ বাতাসে। আকাশে সামান্য একটু জ্যোৎস্না উঠেছে কৃষ্ণাতিথির।
নন্দীদের বাগানে শেয়াল ডেকে উঠলো। রাত হয়েচে নিতান্ত কমও নয়। এ পাড়া নিম্নতি হয়ে এসেছে।
ময়না আবার এসে বললে–পা টিপে দেবো?
–না না, তুই যা। ভারি আমার
–দিই না।
রাত হয়েচে। শুগে যা। কাল সকালে আমায় ডেকে দিবি। সাতবেড়েতে যাবো জমি দেখতি।
–ডাকবো। পা টিপতি হবে না তো?
–না, তুই যা।
নালু পাল বাড়ি ফিরবার পথে সন্নিসিনীর আখড়ায় একটা করে আধলা পয়সা দিয়ে যায় প্রতি রাত্রে। দেবদ্বিজে ওর ভক্তি, ব্যবসায় উন্নতি তো হবে ওঁদেরই দয়ায়। সন্নিসিনীর আশ্রম বাঁওড়ের ধারের রাস্তার পাশে প্রাচীন এক বটবৃক্ষতলে, নিবিড় সাঁইবাবলা বনের আড়ালে, রাস্তা থেকে দেখা যায় না। সন্নিসিনীর বাড়ি ধোপাখোলা, সে নাকি হঠাৎ স্বপ্ন পেয়েছিল, এ গ্রামের এই প্রাচীন বটতলার জঙ্গলে শ্মশানকালীর পীঠস্থান সাড়ে তিনশো বছর ধরে লুকোনো। তাই সে এখানে এসে জঙ্গল কেটে আশ্রম বসিয়েছিল বছর সাতেক আগে। এখন তার অনেক শিষ্যসেবক, পুজোআচ্চা ধন্না দিতে আসে ভিন্ন গ্রামের কত লোক।
সন্ধ্যার পরে যারা আসে, বৈঁচি গাছের জঙ্গল ঘেঁষে যে খড়ের নিচু ঘরখানা, যার মাথার উপর বটগাছের ডালটা, যেখানে বাসা বেঁধেছে অজস্র বাবুই, যেখানে ঝোলে কলাবাদুড়ের পাল, রাত্রের অন্ধকারে সেই ঘরটির দাওয়ায় বসে ওরা গাঁজার আড্ডা জমায়।
নালুকে বললে ছিহরি জেলে, কেডা গা? নালু?
–হ্যাঁ।
–কি করতি এলে?
–মায়ের বিত্তিটা দিয়ে যাই। রোজ আসি।
–বিত্তি?
–হ্যাঁ গো।
–কত?
–দশকড়া। আধপয়সা।
–বসো। একটু ধোঁয়া ছাড়বা না?
–না, ওসব চলে না। বোসো তোমরা। আর কে কে আছে?
–নেই এখন কেউ। হরি বোষ্টম আসে, মনু যুগী আসে, দ্বারিক কর্মকার আসে, হাফেজ আসে, মনসুর নিকিরি আসে।
নালু কি একটা কথা বলতে গিয়ে বড় অবাক হয়ে গেল। তার চোখকে যেন বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে উঠলো। দেওয়ানবাড়ির জামাই বাঁড়ুয্যে মশায়কে সে হঠাৎ দেখতে পেলে অশ্বথতলার দিকে আসতে। উনিও কি এখানে গাঁজার আডড়ায়?
নালু দাঁড়ালো চুপ করে দাওয়ার বাইরে হেঁচতলায়।
ভবানী বাঁড়ুয্যে এসে বটতলায় বসলেন আসনের সামনে। মূর্তি নেই, ত্রিশূল বসানো সিঁদুরলেপা একটা উঁচু জায়গা আছে গাছতলায়, আসন বলা হয় তাকেই। ভবানী বাঁড়ুয্যে একমনে বসে থাকবার পরে সন্নিসিনী সেখানে এসে বসলো তার পাশেই। সন্নিসিনীর রং কালো, বয়েস পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ, মুখশ্রী তাড়কা রাক্ষসীকে লজ্জা দেয়, মাথার দুদিক থেকে দুটি লম্বা জট এসে কোলের ওপর পড়েচে।
ভবানী বললেন–কি খেপী, খবর কি?
–ঠাকুর, কি খবর বলো।
–সাধনা-টাধনা করচো?
–আপনাদের দয়া। জেতে হাড়িডোম, কি সাধনা করবো আমরা ঠাকুর? আজও আসনসিদ্ধি হোলো না দেবতা।
-আমি আসবো সামনের অমাবস্যেতে, দেখিয়ে দেবো প্রণালীটা।
–ওসব হবে না ঠাকুর। আর ফাঁকি দিও না। আমাকে শেখাও।
–দূর খেপী, আমি কি জানি? তাঁর দয়া। আমি সাধন-ভজন করিও নে, মানিও নে–তবে দেখি তোমাদের এই পর্যন্ত।
–আমায় ঠকাতে পারবে না ঠাকুর। তুমি রোজ এখানে আসবে, সন্দের পর। যত সব অজ্ঞান লোকেরা ভিড় করে রাতদিন; নিয়ে। এসো ওষুধ, নিয়ে এসো মামলা জেতা, ছেলে হওয়া–
–সে তোমারই দোষ। সেটা না করতেই পারতে গোড়া থেকে। ধন্না দিতে দিলে কেন?
–তুমি ভুলে যাচ্চ। এ জায়গাটা গোরাসাহেবের বাংলা নয়–তবে এত লোক আসে কেন? ধর্মের জন্যে নয়। অবস্থা ঘোরাবার জন্যে! মামলা জেতবার জন্যে!
–সে তো বুঝি।
–একটু থেকে দেখবেন না দিনের বেলায়। এত রাতে আর কি আছে? চলে গেল সবাই। কি বিপদ যে আমার। সাধন-ভজন সব যেতে বসেচে, ডাক্তার বদ্যি সেজে বসেচি। শুধু রোগ সারাও, আর রোগ সারাও।
নালু পাল এ সব শুনে কিছু বুঝলে, কিছু বুঝলে না। ভবানী বড়য্যেকে সে অনেকবার দেখেচে, দেওয়ান মহাশয়ের জামাই সুচেহারার লোক বটে, দেখলে ভক্তি হয়। বাড়ি ফিরে মাকে সে বল্লে–একটা চমৎকার জিনিস দেখলাম আজ! সন্নিসিনীর গুরু হলেন আমাদের দেওয়ানজির ভগ্নিপতি বড়দিদি-ঠাকরুনের বর। তিন দিদি-ঠাকরুনেরই বর। সব কথা বোঝলাম না, কি বল্লেন, কিন্তু সন্নিসিনী যে অত বড়, সে একেবারে তটস্থ।