–ঘোড়ায় যাবেন?
–না, বোধ হয় টমটমে। আমি দাঁড়াবো না।
মোল্লাহাটি নীলকুঠির বড়সাহেব শিপটনকে এ অঞ্চলে বাঘের মতো ভয় করে লোকে। লম্বাচওড়া চেহারা, বাঘের মতো গোল মুখখানা, হাতে সর্বদাই চাবুক থাকে। এ অঞ্চলের লোক চাবুকের নাম রেখেছে ‘শ্যামচাঁদ’। কখন কার পিঠে শ্যামচাঁদ অবতীর্ণ হবে তার কোনো স্থিরতা না থাকাতে সাহেব রাস্তায় বেরুলে সবাই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে।
এমন সময়ে আর একজন হাটুরে দোকানদার সতীশ কলু, মাথায় সর্ষে তেলের বড় ভাঁড় চ্যাঙারিতে বসিয়ে সেখানে এসে পড়লো। রাস্তার ধারে নালুকে দেখে বললে–চল, যাবা না?
–বোসো। তামাক খাও!
–তামাক নেই।
–আমার আছে। দাঁড়াও, শিপটন্ সাহেব চলে যাক আগে।
–সায়েব আসচে কেডা বললে?
–রায়মশায় বলে গ্যালেন—বোসো—
হঠাৎ সতীশ কলু সামনের দিকে সভয়ে চেয়ে দেখে ষাঁড়া আর শেওড়া ঝোপের পাশ দিয়ে নিচের ধানের ক্ষেতের মধ্যে নেমে গেল। যেতে যেতে বললে–চলে এসো, সায়েব বেরিয়েছে–
নালু পাল পানের মোট গাছতলায় ফেলে রেখেই সতীশ কলুর অনুসরণ করলে। দূরে ঝুমঝুম্ শব্দ শোনা গেল টমটমের ঘোড়ার। একটু পরে সামনের রাস্তা কাঁপিয়ে সাহেবের টমটম কাছাকাছি এসে পড়লো এবং থামবি তো থাম একেবারে নালু পালের আশ্রয়স্থল ওদের বটতলায়, ওদের সামনে।
বটতলায় পানের মোট মালিকহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সাহেব হেঁকে বললে–এই! মোট কাহার আছে?
নালু পাল ও সতীশ কলু ধানগাছের আড়ালে কাঠ হয়ে গিয়েচে ততক্ষণ। কেউ উত্তর দেয় না।
টমটমের পেছন থেকে নফর মুচি আরদালি হাঁকল-কার মোট পড়ে রে গাছতলায়? সাহেব বললে–উট্টর ডাও–কে আছে?
নালু পাল কাঁচুমাচু মুখে জোড়হাতে রাস্তায় উঠে আসতে আসতে বললে–সায়েব, আমার। সাহেব ওর দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। কোনো কথা বললে না।
নফর মুচি বললে–তোমার মোট?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কি করছিলে ধানক্ষেতে?
–আজ্ঞে আজ্ঞে
সাহেব বললে–আমি জানে। আমাকে ডেখে সব লুকায়। আমি সাপ আছি, না বাঘ আছি হ্যাঁ?
প্রশ্নটা নালু পালের মুখের দিকে তাকিয়েই, সুতরাং নালু পাল ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলে–না সায়েব।
–ঠিক! মোট কিসের আছে?
–পানের, সায়েব।
–মোল্লাহাটির হাটে নিয়ে যাচ্ছে?
–হ্যাঁ।
–কি নাম আছে টোমার?
–আজ্ঞে, শ্রীনালমোহন পাল।
–মাথায় করো। ভবিষ্যতে আমায় ডেখে লুকাবে না। আমি বাঘ নই, মানুষ খাই না। যাও–বুঝলে!
–আজ্ঞে
সাহেবের টমটম চলে গেল। নালু পালের বুক তখন ঢিপঢিপ করছে। বাবাঃ, এক ধাক্কা সামলানো গেল বটে আজ। সে শিস দিতে দিতে ডাকলো–ও সতীশ খুড়ো!
সতীশ কলু ধানগাছের আড়ালে আড়ালে রাস্তা থেকে আরো দূরে চলে গিয়েছিল। ফিরে কাছে আসতে আসতে বললে–যাই।
বাবাঃ, কতদূর পালিয়েছিলে? আমায় ডাকতে দেখে বুঝি দৌড় দিলে ধানবন ভেঙ্গে?
-কি করি বলো। আমরা হলাম গরিব-গুরবো নোক। শ্যামচাঁদ পিঠে বসিয়ে দিলে করচি কি ভাই বলো দিনি। কি বললে সায়েব তোমারে?
–বললে ভালোই।
–তোমারে রায়মশায় কি বলছিল?
-বলছিল, সাহেব আসচে। সোজা হয়ে বসো।
–তা বলবে না? ওরাই তো সায়েবের দালাল। কুটির দেওয়ানি করে সোজা রোজগারটা করেচে রায়মশাই! অতবড় দোমহলা বাড়িটা তৈরি করেছে সে-বছর।
.
রায়মশায়ের পুরো নাম রাজারাম রায়। মোল্লাহাটি নীলকুঠির দেওয়ান। সাহেবের খয়েরখাঁই ও প্রজাপীড়নের জন্যে এদেশের লোকে যেমন ভয় করে, তেমনি ঘৃণা করে। কিন্তু মুখে কারো কিছু বলবার সাহস নেই। নিকটবর্তী পাঁচপোতা গ্রামে বাড়ি।
বিকেলের সূর্য বাগানের নিবিড় সবুজের আড়ালে ঢলে পড়েছে, এমন সময় রাজারাম রায় নিজের বাড়িতে ঢুকে ঘোড়া থেকে নামলেন। নফর মুচির এক খুড়তুতো ভাই ভজা মুচি এসে ঘোড়া ধরলে। চণ্ডীমণ্ডপের দিকে চেয়ে দেখলেন অনেকগুলো লোক সেখানে জড়ো হয়েচে। নীলকুঠির দেওয়ানের চণ্ডীমণ্ডপে অমন ভিড় বারো মাসই লেগে আছে। কত রকমের দরকার করতে এসেছে নানা গ্রামের লোক, কারো জমিতে ফসল ভেঙ্গে নীল বোনা হয়েচে জোর-জবরদস্তি করে, কারো নীলের দাদনের জন্যে যে জমিতে দাগ দেওয়ার কথা ছিল তার বদলে অন্য এবং উৎকৃষ্টতর জমিতে কুঠির আমীন গিয়ে নীল বোনার জন্যে চিহ্নিত করে এসেচে–এইসব নানা রকমের নালিশ।
নালিশের প্রতিকার হত। নতুবা দেওয়ানের চণ্ডীমণ্ডপে লোকের ভিড় জমতো না রোজ রোজ। তার জন্যে ঘুষ-ঘাষের ব্যবস্থা ছিল না। রাজারাম রায় কারো কাছে ঘুষ নেবার পাত্র ছিলেন না, তবে কার্য অন্তে কেউ একটা রুই মাছ, কি বড় একটু মানকচু কিংবা দুভাড় খেজুরের নলেন গুড় পাঠিয়ে দিলে ভেটস্বরূপ, তা তিনি ফেরত দেন বলে শোনা যায় নি।
রাজারামের স্ত্রী জগদম্বা এক সময়ে বেশ সুন্দরী ছিলেন, পরনে লালপেড়ে তাঁতের কোরা শাড়ি, হাতে বাউটি পৈঁছে, লোহার খাড় ও শাঁখা, কপালে চওড়া করে সিঁদুর পরা, দোহারা চেহারার গিন্নিবান্নি মানুষটি।
জগদম্বা এগিয়ে এসে বললেন–এখন বাইরে বেরিও না। সন্দে আহ্নিক সেরে নাও আগে।
রাজারাম হেসে স্ত্রীর হাতে ছোট একটা থলি দিয়ে বললেন–এটা রেখে দাও। কেন, কিছু জলপান আছে বুঝি?
–আছেই তো। মুড়ি আর ছোলা ভেজেছি।
–বাঃ বাঃ, দাঁড়াও আগে হাত-পা ধুয়ে নিই। তিলু বিলু নিলু কোথায়?
–তরকারি কুটচে।
–আমি আসছি। তিলুকে জল দিতে বলো।
–সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর রাজারাম আহ্নিক করতে বসলেন রোয়াকের একপ্রান্তে। তিলু এসে আগেই সেখানে একখানা কুশাসন পেতে দিয়েচিল। অনেকক্ষণ ধরে সন্ধ্যা-আহ্নিক করলেন–ঘণ্টাখানেক প্রায়। অনেক কিছু স্তব-স্তোত্র পড়লেন।