এখানে বসে সে সস্তায় হাট করে। একটি মেয়ে লাউশাক বিক্রি করতে যাচ্ছে, নালু পাল বললে–শাক কত?
–আট কড়া।
–দূর, ছকড়া কালও কিনিচি। শাক আবার আটকড়া। কখনো বাপের জন্মে শুনি নি। দে ছকড়া করে।
–দিলি বড় খেতি হয়ে যায় যে টাটকা শাক, এখুনি তুলি নিয়ে অ্যালাম।
–দিয়ে যা রে বাপু। টাটকা শাক ছাড়া বাসি আবার কে বেচে?
দুটি কচি লাউ মাথায় একটা ঝুড়িতে বসিয়ে একজন লোক যাচ্ছে। নালুর দৃষ্টি শাক থেকে সেদিকে চলে গেল।
–বলি ও দবিরুদ্দি ভাই। শোনো শোনো ইদিকি–
–কি? লাউ তুমি কিনতি পারবা না। ছস্তায় দিতি পারবো না।
–কত দাম?
–দুপয়সা এক একটা।
দোকানের তাবৎ লোক দর শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। সকলেই ওর দিকে চাইতে লাগল। একজন বললে–ঠাট্টা করলে নাকি?
দবিরুদ্দি মাথার লাউ নামিয়ে একজনের হাত থেকে কল্কে নিয়ে হেসে বললে–ঠাট্টা করবো কেন! মোরা ঠাট্টার যুগ্যি নোক?
নালু হেসে বললে–কথাটা উল্টো বলে ফেললে। আমরা কি তোমার ঠাট্টার যুগ্যি লোক? আসল কথাটা এই হবে। এখন বল কত নেবা?
–একপয়সা দশ কড়া দিও।
-না, এক পয়সা পাঁচ কড়া নিও। আর জ্বালিও না বাপু, ওই নিয়ে খুশি হও। দুটো লাউই দিয়ে যাও।
বৃদ্ধ হরি নাপিত বসে তামাকের গুল একটা পাতায় জড়ো করছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলে ভূধর ঘোষ–ও কি হচ্চে?
–দাঁত মাজবো বেবেলা। লাউ একটা কিনবো ভেবেলাম তা দর দেখে কিনতি সাহস হোল না। এই মোল্লাহাটির হাটে জনস সাহেবের আমলে অমন একটা লাউ ছকড়া দিয়ে কিনিচি। দশ কড়ায় অমন দুটো লাউ পাওয়া যেত। আমার তখন নতুন বিয়ে হয়েচে, পার্শ্বনাথ ঘোষের বাড়ী ওর বড় ছেলের বৌভাতে একগাড়ি তরকারি এয়েল, এক টাকা দাম পড়ল মোটমাট। অমন লাউ তার মধ্যি পনেরো-বিশটা ছিল। পটল, কুমড়ো, বেগুন, ঝিঙে, থোড়, মোচা, পালংশাক, শশা তো অগুতি। এখন সেই রকম একগাড়ি তরকারি দুটাকার কম নয়।
অক্রূর জেলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে–নাঃ, মানুষের খাদ্যখাদক কেরমেই অনাটন হয়ে উঠেছে। মানুষের খাবার দিন চলে যাচ্ছে, আর খাবে কি? এই সবাইপুরে দুধ ছিল ট্যাকায় বাইশ সের চব্বিশ সের। এখন আঠারো সেরের বেশি কেউ দিতি চায় না।
২. সন্দেশ–ছানা
নালু পাল বললে–আঠারো সের কি বলচো খুড়ো? আমাদের গাঁয়ে ষোল সেরের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। একটু সন্দেশ করবো বলে ছানা কিনতি গিয়েছিলাম অঘোর ঘোষের কাছে, তা নাকি দুআনা করে খুলি! এক খুলিতে বড় জোর পাঁচপোয়া ছানা থাকুক
অক্রূর জেলে হতাশভাবে বললে–নাঃ আমাদের মত গরীবগুরবো না খেয়েই মারা যাবে। অচল হয়ে পড়লো কেরমেশে।
–তা সেই রকমই দাঁড়িয়েছে।
দবিরুদ্দি নিজেকে যথেষ্ট তিরস্কৃত বিবেচনা করে এক একটা লাউ এক এক পয়সা হিসাবে দাম চুকিয়ে নিয়ে হাটের দিকে চলে গেল। নালু পাল তাকে একটা পয়সা দিয়ে বললে–অমনি এক কাজ করবা। এক পয়সার চিংড়ি মাছ আমার জন্যে কিনে এনো। লাউ দিয়ে চিংড়ি দিয়ে তবে মজে। বেশ ছটকালো দেখে দোয়াড়ির চিংড়ি আনবা।
হরি নাপিত বললে–চালখান ছেয়ে নেবো বলে ঘরামির বাড়ি গিইছিলাম। চার আনা রোজ ছেল বরাবর, সেদিন সোনা ঘরামি বললে কিনা চার আনায় আর চাল ছাইতে পারবো না, পাঁচ আনা করি দিতি হবে। ঘরামি জন পাঁচ আনা আর একটা পেটেল দুআনা–তা হলি একখানা পাঁচচালা ঘর ছাইতে কত মজুরি পড়লো বাপধনেরা? পাঁচ-ছ টাকার কম নয়।
বর্তমান কালের এই সব দুর্মূল্যতার ছবি অক্রূরকে এত নিরাশ ও ভীত করে তুলোে যে সে বেচারি আর তামাক না খেয়ে কল্কেটি মাটিতে নামিয়ে রেখে হহ করে চলে গেল।
কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার তাকে ফিরতে হল। অক্রূর জেলের বাড়ি পাশের গ্রাম পুস্তিঘাটায়। তার বড় ছেলে মাছ ধরার বাঁধাল দিয়েচে সবাইপুরের বাঁওড়ে। হঠাৎ দেখা গেল দূরে ডুমুরগাছের তলায় সে আসচে, মাথায় চুপড়িতে একটা বড় মাছ।
অক্রূর চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। অত বড় মাছটা কি তার ছেলে পেয়েছে নাকি? বিশ্বাস তো হয় না! আজ হাট করবার পয়সাও তার হাতে নেই। যত কাছে আসে ওর ছেলে, তত ওর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। হয়ে ওঠে। ওঃ, মস্ত বড় মাছটা দেখচি!
দূর থেকে ছেলে বললে-কনে যাচ্চ বাবা?
বাড়ি যাচ্ছিলাম। মাছ কাদের?
–বাঁধালের মাছ। এখন পড়লো।
–ওজন?
–আট সের দশ ছটাক। তুমি মাছটা নিয়ে হাটে যাও।
–তুই কনে যাবি?
–নৌকো বাঁওড়ের মুখে রেখে অ্যালাম যে। ঝড় হলি উড়ে বেরিয়ে যাবে। তুমি যাও।
নালু পালের দোকানে খদ্দেরের ভিড় আরম্ভ হবে সন্দে বেলা। এই সময়টা সে পাঁচজনের সঙ্গে গল্পগুজব করে দিন কাটায়। অক্রূর জেলেকে দোকানের সবাই মিলে দাঁড় করালে। বেশ মাছটা। এত বড় মাছ অবেলায় ধরা পড়ল?
নালু বললে–মাছটা আমাদের দিয়ে যাও অক্রূরদা
-ন্যাও না। আমি বেঁচে যাই তা হলি। অবেলায় আর হাটে যাই
–দাম কি?
–চার ট্যাকা দিও।
-বুঝে-সুজে বল অক্রূরদা। অবিশ্যি অনেকদিন তুমি বড় মাছ। বিক্রি কর নি, দাম জানো না। হরি কাকা, দাম কত হতে পারে?
হরি নাপিত ভালো করে মাছটা দেখে বললে–আমাদের উঠতি বয়েসে এ মাছের দাম হত দেড় ট্যাকা! দাও তিন টাকাতে দিয়ে। যাও।
–মাপ করো দাদা, পারবো না। বড় ঠকা হবে।
–আচ্ছা, সাড়ে তিন টাকা পাবা। আর কথাটি বোলো না, আজ দুট্যাকা নিয়ে যাও। কাল বাকিটা নেবে।