–এ কতদিন আগের কথা?
–অনেক দিনের। আমি তখন জন্মিচি কিন্তু আমার জ্ঞান হয় নি। পিসিমাকে আমি মনে করতে পারি নে। বড় হয়ে মার মুখে বৌদির মুখে শুনতাম। বৌদি তখন কনেবৌ, সবে এসেচে এ বাড়ি।
তিলু চুপ করল, ভবানী বাঁড়ুয্যেও কতক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভবানী বাঁড়ুয্যের মনে হল বৃথাই তিনি সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সমাজের এই অত্যাচারিতদের সেবার জন্যে বারবার তিনি সংসারে আসতে রাজি আছেন। মুক্তি-টুক্তি এর তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ।
কতদিন আগের সেই অভাগিনী কুলীন কুমারীর স্মৃতি বহন করে ইছামতী তাঁদের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে, তাঁরই না-মেটা স্বামী সাধের পুণ্য-চোখের জল ওর জলে মিশে গিয়েচে কতদিন আগে। আজ এই পানকলস ফুলের গন্ধ মাখানো চাঁদের আলোয় তিনিই যেন স্বর্গ থেকে নেমে বললেন–বাবা, আমার যে সাধ পোরে নি, তোমার সামনে যে বসে আছে এই মেয়েটির তুমি সে সাধ পুরিও। বাংলা দেশের মেয়েদের ভালো স্বামী হও, এদের সে সাধ পূর্ণ হোক আমার যা পুরলো না–এই আমার আশীর্বাদ!
ভবানী বাঁড়ুয্যে তিলুকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন।
.
যখন ওরা দেওয়ানবাড়ি পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েচে, একদণ্ড রাত্রিও কেটে গিয়েচে। জগদম্বা বললেন–ওমা, তোরা ছিলি কোথায় রে তিলু? নিলু এসেছিল এই খানিক আগে। বললে, তারা কতক্ষণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আমি জামাইয়ের জন্যে আহ্নিকের জায়গা করে জলখাবার গুছিয়ে বসে আছি ঠায়, কি যে কাণ্ড তাদের
তিলু বলে–কাউকে বোলো না বৌদিদি, উনি নদীর ধারে নিয়ে। গিয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি ওঁকে জলখাবার খাইয়ে দাও। আমার মন কেমন করচে খোকনের জন্যে। কতক্ষণ দেখি নি। নিলু কি বললে, খোকন কাঁদছে না তো।
–না, খোকন ঘুমিয়ে পড়েছে নিলু বলে গেল। তুই খেয়ে নে—
–উনি আহ্নিক করুন আগে। দাদা আসেন নি?
–তাঁর ঘোড়া গিয়েচে আনবার জন্য।
জলখাবার সাজিয়ে দিলেন জগদম্বা জামাইয়ের সামনে। শালাজ-বৌ হলেও ভবানী তাঁকে শাশুড়ির মতো সম্মান করেন। জগদম্বা ঘোমটা দিয়ে ছাড়া বেরোন না জামাইয়ের সামনে! মুগের ডাল ভিজে, পাটালি, খেজুরের রস, নারকেল নাড়, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ এবং ফেনিবাতাসা। তিলু খেতে খেতে বললে–বিলু-নিলুকে দিয়ে?
–নিলু এসে খেয়ে গিয়েচে, বিলুর জন্যি নিয়ে গিয়েচে।
–এবার যাই বৌদি। খোকন হয়তো উঠে কাঁদবে।
–জামাইকে নিয়ে আবার পরেও আসবি। দুখানা আঁদোসা ভেজে জামাইকে খাওয়াবো। খেজুরের রসের পায়েস করবো সেদিন। আজ মোটে এক ভাড় রস দিয়ে গেল ভজা মুচির ভাই, নইলে আজই করতাম।
–শোনো বৌদি। তোমাদের জামাই বলে কিনা আমার বাঙালে কথা। বলে–শিবির মাটি, পুবির ঘর। আবার এক ছড়া বার করেচে মুগির ডালি ঘি দিলি নাকি ক্ষীরির তার হয়–হি হি
–আহা, কি শহুরে জামাই! দেবো একদিন শুনিয়ে। তবুও যদি দাড়িতে জট না পাকাতো! আমি যখন প্রথম দেখি তখন এত বড় দাড়ি, যেন নারদ মুনি।
–তোমাদের জামাই তোমরাই বোঝো বৌদি। আমি যাই, খোকন ঠিক উঠেছে। আবার আসবো পরশু।
পথে বার হয়ে ভবানী আগে আগে, তিলু পেছনে ঘোমটা দিয়ে চলতে লাগলো। পাড়ার মধ্যে দিয়ে পথ। এখানে ওদের একত্র ভ্রমণ বা কথোপকথন আদৌ চলবে না।
চন্দ্র চাটুয্যের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে দিয়ে রাস্তা। রাত্রে সেখানে দাবার আজ্ঞা বিখ্যাত। সম্পর্কে চন্দ্র চাটুয্যে হলেন তিলুর মামাশ্বশুর। তিলুর বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো, যদি মামাশ্বশুর দেখে ফেলেন? এত রাতে সে স্বামীর সঙ্গে পথে বেরিয়েছে!
চণ্ডীমণ্ডপের সামনাসামনি যখন ওরা এসেচে তখন চণ্ডীমণ্ডপের ভিড়ের মধ্যে থেকে কে জিজ্ঞেস করে উঠল–কে যায়?
ভবানী গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন–আমি।
–কে, ভবানী?
-হ্যাঁ।
–ও।
লোকটা চুপ করে গেল। তিলু আরো এগিয়ে গিয়ে ফিফিস্ করে বললে–কে ডাকলে?
মহাদেব মুখুয্যে।
–ভালো জ্বালা। আমাকে দেখলে নাকি?
–দেখলে তাই কি? তুমি আমার সঙ্গে থাক, অত ভয়ই বা কিসের?
–আপনি জানেন না এ গাঁয়ের ব্যাপার। ঐ নিয়ে কাল হয়তো রটনা রটবে। বলবে, অমুকের বৌ সদর রাস্তা দিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল গটগট করে।
–বয়েই গেল! এসব বদলে যাবে তিল, থাকবে না, সেদিন আসচে। তোমার আমার দিন চলে যাবে। ঐ খোকন যদি বাঁচে ওর বৌকে নিয়ে ও পাশাপাশি হেঁটে বেড়াবে এ গায়ের পথে–কেউ কিছু মনে করবে না।
.
নালু পাল একখানা দোকান করেচে। ইছামতী থেকে যে বাঁওড় বেরিয়েছে, এটা ইছামতীরই পুরোনো খাত ছিল একসময়ে। এখন আর সে খাতে স্রোত বয় না, টোপাপানার দাম জমেচে। নালু পালের দোকান এই বাঁওড়ের ধারে, মুদির দোকান একখানা ভালোই চলে এখানে, মোল্লাহাটির হাটে মাথায় করে জিনিস বিক্রি করবার সময়ে সে লক্ষ্য করেছিল।
নালু পালের দোকানে খদ্দের এল। জাতে বুনো, এদের পূর্বপুরুষ নীলকুঠির কাজের জন্যে এদেশে এসেছিল সাঁওতাল পরগণা থেকে। এখন এরা বাংলা বেশ বলে, কালীপূজো মনসাপূজো করে, বাঙালি মেয়ের মতো শাড়ি পরে।
একটি মেয়ে বললে–দুপয়সার তেল আর নুন দ্যাও গো। মেঘ উঠেচে, বিষ্টি আসবে–
একটি মেয়ে আঁচল থেকে খুললে চারটি পয়সা। সে কড়ি ভাঙ্গাতে এসেচে। এক পয়সায় পাঁচগণ্ডা কড়ি পাওয়া যায়–আজ সবাইপুরের হাট, কড়ি দিয়ে শাক বেগুন কিনবে।
নালু পাল আজ বড় ব্যস্ত। হাটবারের দিন আজ, সবাইপুর গ্রাম এখান থেকে আধমাইল, সব লোক হাটের ফেরত ওর দোকান থেকে জিনিস কিনে নিয়ে যাবে। পয়সার বাক্স আলাদা, কড়ির বাক্স আলাদা– সে জিনিস বিক্রি করে নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলছে।