–দিদিকে বলবো এখন।
–খোকাকে নিয়ে যেন আসে না, সন্দের পর।
–তোমাদের জামাই না ফিরে এলি তো দিদি আসতে পারবে না। তিনি গুণমণি ফেরেন রাতে।
–কোথা থেকে?
–তা বলতে পারি নে।
–সন্ধান-টন্ধান নিবি। পুরুষের বার-দোষ বড় দোষ
–সে-সব নেই তোমাদের জামাইয়ের বৌদি। ও অন্য এক ধরনের মানুষ। সন্নিসি গোছের লোক। সন্নিসি হয়েই তো গিয়েছিল জানো তো! এখনো সেই রকম। সংসারে কোনো কিছুতেই নেই। দিদি যা করবে তাই।
–আহা বড্ড ভালোমানুষ। আমার বড্ড দেখতি ইচ্ছে করে। সন্দের সময় আজ দুজনকেই একটু আসতি বলিস। এখানেই আহ্নিক করে জল খাবেন জামাই।
ভবানী নদীর ধার থেকে সন্দের পর ফিরে আসতেই নিলু বললে– শুনুন, আপনাকে আর দিদিকে জোড়ে যেতি হবে ও-বাড়ি–বৌদিদির হুকুম
–আর, তুমি আর বিলু?
–আমাদের কে পোঁছে? নাগর-নাগরী গেলেই হোললা–
–আবার ওইসব কথা?
–ঘাট হয়েচে। মাপ করুন মশায়।
এমন সময়ে তিলু এসে দুজনকে দেখে হেসে ফেললে। বললে, বেশ তো বসে গল্পগুজব করা হচ্ছে। আহ্নিকের জায়গা তৈরি যে–
ভবানী বললেন–নিলু বলচে তোমাকে আর আমাকে ও-বাড়ি যেতে বলেচে বৌদিদি।
তিলু বললে–বেশ চলুন। খোকনকে ওদের কাছে রেখে যাই।
দিব্যি জ্যোৎস্না উঠেছে সন্ধ্যার পরেই। শীত এখনো সামান্য আছে, গাছে গাছে আমের মুকুল ধরেছে, এখনো আম্রমুকুলের সুগন্ধ ছড়াবার সময় আসে নি। দুএকটি কোকিল এখনো ডেকে ওঠে বড় বকুল গাছটায় নিবিড় শাখা-প্রশাখার মধ্যে থেকে।
ভবানী বললেন–তিলু, বসবে? চলো নদীর ধারে গিয়ে একটু বসা যাক।
তিলুর নিজের কোনো মত নেই আজকাল। বললে–চলুন। কেউ দেখতি পাবে না তো?
–পেলে তাই কি?
–আপনার যা ইচ্ছে–
–রায়দের ভাঙ্গাবাড়ির পেছন দিয়ে চলো। ও পথে ভূতের ভয়ে। লোক যায় না।
নদীর ধারে এসে দুজনে দাঁড়ালো একটা বাঁশঝাড়ের তলায়, শুকনো পাতার রাশির ওপরে; তিলু বললে–দাঁড়ান, আঁচলটা পেতে নিচে বসুন–
-তুমি আঁচল খুলো না, ঠাণ্ডা লাগবে
–আমার ঠাণ্ডা লাগে না, বসুন আপনি
–বেশ লাগচে, না?
তিলু হেসে বললে–সত্যি বেশ, সংসার থেকে তো বেরুনোই হয় আজকাল–কাজ আর কাজ। বিলু নিলু সংসারের কি জানে? ছেলেমানুষ। আমি যা বলে দেবো, তাই ওরা করে। সব দিকেই আমার ঝক্কি।
তিলুর কথার সুরে যশোর জেলার গ্রাম্য টানগুলি ভবানী বাঁড়ুয্যের এত মিষ্টি লাগে। তিনি নিজে নদীয়া জেলার লোক, সেখানকার বাংলার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি সুমার্জিত। এদেশে এসে প্রথমে শুনলেন এই ধরনের কথা।
হেসে বললেন–শোনো, তোমাদের দেশে বলে কি জানো? শিবির মাটি, পুবির ঘর–মুগির ডালি ঘি দিলি ক্ষীরির তার হয়–
–কি, কি?
–মুগির ডালি মানে মুগের ডালে, ঘি দিলি মানে ঘি দিলে–
–থাক্ ও, আপনার মানে বলতি হবে না। ও কথা আপনি প্যালেন কোথায়?
–এই দেখচি দেশের বুলি ধরেচ, বলতি হবে না, প্যালেন কোথায়! তবে মাঝে মাঝে চেপে থাকো কেন?
–লজ্জা করে আপনার সামনে বলতি–
ভবানী তিলুকে টেনে নিলেন আরো কাছে। জ্যোৎস্না বাঁকা ভাবে এসে সুন্দরী তিলুর সমস্ত দেহে পড়েচে, বয়স ত্রিশ হলেও স্বামীকে পাবার দিনটি থেকে দেহে ও মনে ও যেন উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী হয়ে গিয়েচে। বালিকাজীবনের কতদিনের অতৃপ্ত সাধ, কুলীনকুমারীর। অতি দুর্লভ বস্তু স্বামী-রত্ন এতকালে সে পেয়েছে হাতের মুঠোয়। তাও এমন স্বামী। এখনো যেন তিলুর বিশ্বাস হয় না। যদিও আজ দুবছর হয়ে গেল।
তিলু বললে–আমার মনে হয় কি জানেন? আপনি আসেন নি বলেই আমাদের এতদিন বিয়ে হচ্ছিল না–কুলীনের মেয়ের বিয়ে
–আচ্ছা, একটা কথা বুঝলাম না। রায় উপাধি তোমাদের, রায়। আবার কুলনী কিসের! রায় তো শ্রোত্রিয়
–ওকথা দাদাকে জিজ্ঞেস করবেন। আমি মেয়েমানুষ, কি জানি। আমরা কুলীন সত্যিই। আমার দুই পিসি ছিলেন, তাঁদের বিয়ে হয় না কিছুতেই। ছোট পিসি মারা যাওয়ার পরে বড় পিসিকে বিয়ে করে নিয়ে গেল কোথায় আজ বাঙাল দেশে–ভালো কুলীনের ছেলে–
–আহা, তোমরা আর বাঙাল দেশ বোলো না। যশুরে বাঙাল কোথাকার! মুগির ডালি ঘি দিলি ক্ষীরির তার হয়। শিবির মাটি, পুবির ঘর–
–যান আপনি কেবল ক্ষ্যাপাবেন–আর আপনাদের যে গেলুম মলুম হালুম হুলুম-হি হি হি হি
–আচ্ছা থাক! তারপর?
-তখন বড় পিসির বয়েস চল্লিশের ওপর। সেখানে গিয়ে আগের সতীনের বড় বড় ছেলেমেয়ে, বিশ-ত্রিশ বছর বয়েস তাদের। সতীন ছিল না। ছেলেমেয়েরা কি যন্ত্রণা দিত। সব মুখ বুজে সহ্যি করতেন বড় পিসি। নিজের সংসার পেয়েছিলেন কতকাল পরে। একটা বিধবা বড় মেয়ে ছিল, সে পিসিকে কাঠের চ্যালার বাড়ি মারতো, বলতো তুই আবার কে? বাবার নিকের বৌ, বাবার মতিচ্ছন্ন হয়েচে তাই তোকে বিয়ে করে এনেচে। তাও পিসি মুখ বুজি সয়ে থাকতো। অবশেষে বুড়ো বাহাত্তরে স্বামী তুলোে পটল।
–তারপর?
–তারপর সতীনপো সতীনঝিরা মিলে কি দুর্দশা করতে লাগলো পিসির। তারপর তাড়িয়ে দিলে পিসিকে বাড়ি থেকে। পিসি কাঁদে আর বলে–আমার স্বামীর ভিটেতে আমাকে একটু থান দ্যাও। তা তারা দিলে না। পথে বার করে দিলে। সেকালের লজ্জাবতী মেয়েমানুষ, বয়েস হয়েছিল তা কি, কনেবৌয়ের মতো জড়োসড়ো। একজনেরা দয়া করে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিলে। কি কান্না পিসির! তারাই বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। তখনো স্বামী ধ্যান, স্বামী জ্ঞান। বাড়ি এসে পিসিকে একাদশী করতে হয় নি বেশিদিন। ভগবান সতীলক্ষ্মীকে দয়া করে তুলে নিলেন।