–না খুড়োমশায়। মোরে সেখানে থাকতি দ্যায় না।
–শিপটন সায়েবের মেম নাকি ছোটসাহেবের সঙ্গে নাচে?
–ওদের পোড়া কপাল। সবাই সবার মাজা ধরে নাচতি নেগেছে। ঝাঁটা মারুন ওদের মুখি। মুই দেখে লজ্জায় মরে যাই খুডোমশায়।
–বলিস কি।
–হ্যাঁ খুড়োমশাই, মিথ্যে বলচি নে। আপনি না হয় গিয়ে একটু দেখে আসুন, বড়সায়েবের চাপরাসী নফর মুচি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আছে।
–ভজা মুচি কোথায়? ও আমার কথা একটু-আধটু শোনে।
–সেও সেখানে আছে।
–বড়সায়েবও আছে?
–কেন থাকবে না! যাবে কনে?
–ভেতরে ভেতরে কেমন লোক বড়সায়েব?
গয়া সলজ্জ চোখ দুটি মাটির দিকে নামিয়ে বললে–ওই এক রকম। বাইরে যতটা গোঁয়ারগোবিন্দ দেখেন ভেতরে কিন্তু ততটা নয়। বাবাঃ, সব ভালো কিন্তু ওদের গায়ে যে–
–গন্ধ?
–বোটকা গন্ধ তো আছেই! তা নয়, গায়ে বড় ঘামাচি। ঘামাচি পেকে উঠবে রোজ রাত্তিরি। মোর মাথার কাঁটা চেয়ে নিয়ে সেই ঘামাচি রোজ গালবে। কথাটা বলে ফেলেই গয়ার মনে পড়লো, বৃদ্ধ প্রসন্ন আমিনের কাছে, বিশেষত যাকে খুড়োমশাই বলে ডাকে তাঁর কাছে, এ কথাটা বলা উচিত হয় নি। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা হল। বড়–সেটা ঢাকবার চেষ্টায় তাড়াতাড়ি উঠে বললে–যাই খুড়োমশায়, অনেক রাত হোলো। বিস্কুট খাবেন? খান তত এনে দেবো এখন। আর এক জিনিস খায়–তারে বলে চিজ। বড় গন্ধ। মুই একবার মুখি দিয়ে শেষে গা ঘুরে মরি। তবে খেলি গায়ে জোর হয়।
গয়ামেম চলে গেলে প্রসন্ন আমিন মনের সাথে বোতল খুলে বিলিতি মদে চুমুক দিলেন। হাতে পয়সা আসে মন্দ নয় মাঝে মাঝে, দেওয়ানজির কৃপায়। কিন্তু এসব মাল জোটানো শুধু পয়সা থাকলেই বুঝি হয়? হদিস জানা চাই। দেওয়ানজির এসব চলে না, একেবারে কাঠখোট্টা লোক। ও পারে শুধু দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে। কি ভাবেই রাহাতুনপুরটা পুড়িয়ে দিলে রাত্তিরে। এই ঘরে বসেই সব শলাপরামর্শ ঠিক হয়, প্রসন্ন আমিন জানে না কি। ম্যাজিস্ট্রেট আসুক আর যেই আসুক, নীলকুঠির সীমানার মধ্যে ঢুকলে সব ঠাণ্ডা।
তা ছাড়া রাজার জাত রাজার জাতের পক্ষে কথা বলবে না তো কি বলবে কালা আদমিদের দিকে?
খাও দাও, মেমেদের মাজা ধরে নাচো, ব্যস, মিটে গেল।
.
ভবানী বাঁড়ুয্যে বেশ সুখে আছেন।
দেওয়ান রাজারাম রায়ের বাড়ি থেকে কিছুদূরে বাঁশবনের প্রান্তে দুখানা খরের ঘর তৈরি করে সেখানেই বসবাস করচেন আজ দুবছর; তিলুর একটি ছেলে হয়েচে। ভবানী বাঁড়ুয্যে কিছু করেন না, তিন-চার বিঘে ধানের জমি যৌতুকস্বরূপ পেয়েছিলেন, তাতে যা ধান হয়, গত বছর বেশ চলে গিয়েছিল। সে বছর সেই যে সায়েবটি তাঁদের ছবি এঁকে নিয়ে গিয়েছিল, এবার সে সায়েব তাকে একখানা চিঠি আর একখানা বই পাঠিয়েছে বিলেত থেকে। রাজারাম নীলকুঠি থেকে বই আর চিঠি এনে ভবানীর হাতে দেন। হাতে দিয়ে বলেন–ওহে ভবানী, এতে তিলুর ছবি কি করে এল? সাহেব এঁকেছিল বুঝি? চমৎকার একেচে, একেবারে প্রাণ দিয়ে এঁকেচে। কি সুন্দর ভঙ্গিতে একেচে ওকে। ওর ছবি কি করে আঁকলে সাহেব? থাক্ থাক্, এ যেন আর কাউকে দেখিও না এ গাঁয়ে। কে কি মনে করবে। ইংরিজি বই। কি তাতে লিখচে কেউ বলতে পারে না, শুধু এইটুকু বোঝা যায় এই গাঁ এবং যশোর অঞ্চল নিয়ে অনেক জায়গার ছবি আছে। সাহেবটা ভালো লোক ছিল।
তিলু হেসে বললে–দেখলেন, কেমন ছবি উঠেচে আমার!
–আমারও।
–বিলু-নিলুকে দেখাবেন। ওরা খুশি হবে। ডাকি দাঁড়ান
নিলু এসে হৈচৈ বাধিয়ে দিলে। সব তাতেই দিদি কেন আগে? তার ছবি কি উঠতে জানে না? দিদির সোহাগ ভুলতে পারবেন না রসের গুণমণি–অর্থাৎ ভবানী বাঁড়ুয্যে।
তবে আজকাল ওদের অনেক চঞ্চলতা কমেছে। কথাবার্তায় ছেলেমিও আগের মতো নেই। বিলুর স্বভাব অনেক বদলেচে, দুএক মাস পরে তারও ছেলেপুলে হবে।
তিলু কিন্তু অদ্ভুত। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরের আদুরে আবদেরে মেয়ে হয়ে সে ভবানী বাঁড়ুয্যের খড়ের ঘরে এসে কেমন মানিয়ে নিয়ে ঘর আলো করে বসেছে। এখানে কুলুঙ্গি, ওখানে তাক তৈরি করচে নিজের হাতে। নিজেই ঘর গোবর দিয়ে পরিপাটি করে নিকুচ্চে, উনুন তৈরি করচে পুকুরের মাটি এনে, সন্ধের সময় বসে কাঁপাস তুলোর পৈতে কাটে। একদণ্ড বসে থাকবার মেয়ে সে নয়। চরকির মতো ঘুরচে সর্বদা।
বিলুও অনেক সাহায্য করে। দিদি রাঁধে, ওরা কুটনো কুটে দেয়। বিলু ও নিলু দিদির নিতান্ত অনুগত সহোদরা, দিদি যা বলে তাই সই। দিদি ছাড়া ওরা এতদিন কিছু জানতো না–অবিশ্যি আজকাল স্বামীকে চিনেচে দুজনেই। স্বামীর সঙ্গে বসে গল্প করতে ভারি ভালো লাগে।
বৌদিদি জগদম্বা বলেন–ও নিলু, আজকাল যে এ-বাড়ি আর আসিস নে আদপে?
নিলু সলজ্জসুরে বলে–কত কাজ পড়ে থাকে ঘরের। দিদি একা– আমরা না থাকলি–
–তা তো বটেই। আমাদের তো আর ঘরসংসার ছিল না, কেবল তোদেরই হয়েচে, না?
–যা বলো।
–তিলুকে ওবেলা তাই বলছিলাম–
–ও বাবা, দিদি তোমার জামাইকে ফেলি আর খোকনকে ফেলি স্বগুগে যেতি বল্লিও যাবে না।
–তা জানি।
–দিদি একা পারে না বলে খোকনকে নিয়ে আমাদের থাকতি হয়।
–বড্ড ভালো মেয়ে আমার তিলু। সন্দের পর একটু পাঠিয়ে দিস্। উনি কুঠি থেকে আগে আগে ফিরে এলে তিলুই ওঁর তামাক সেজে দিতো জানিস তো। উনি রোজ ফিরে এসে বলেন, তিলু বাড়ি না থাকলি বাড়ি অন্ধকার।