অনেকে এসে কেঁদে পড়লো। দেওয়ানজির কাজ অনেকে বললে, কিছু প্রমাণ তো তেমন কিছু নেই। কেউ তাঁকে বা তাঁর লোককে আগুন দিতে দেখেচে এটা প্রমাণ হোল না। ম্যাজিষ্ট্রেট তদন্ত ভালোভাবেই করলেন। বড়সাহেবকে ডেকে বললেন–আই অ্যাম রিয়্যালি সরি ফর। দি পুওর বেগার্স–উই মাষ্ট ডু সামথিং ফর দেম।
বড়সাহেব বললে–আই ওয়ানডার হু হ্যাঁজ কমিটেড় দিস ব্ল্যাক ডিড়–আই সাসপেক্ট মাই অয়েলি-টাংড় দেওয়ান।
–ইউ থিংক ইট ইজ এ কেস্ অফ আর্সন?
–আই কান্ট টেল–ইয়ার্স এগো আই স এ কেস্ লাইক দিস, অ্যান্ড দ্যাট ওয়াস এ কেস অফ আর্সন–মাই ডেওয়ান ওয়াজ রেসপনসিবল ফর দ্যাট-দি ডেভিল।
ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব একশো টাকা মঞ্জুর করলেন সাহায্যের জন্য, বড়সাহেব দিলেন দুশো টাকা। সাহেবদের জয়জয়কার উঠলো গ্রামে।
সকলে বললে–না, অমন বিচারক আর হবে না। হাজার হোক রাঙা মুখ।
.
সেই রাত্রে কুঠির হলঘরে মস্ত নাচের আসর জমলো। রাঙামুখ সাহেবরা সবাই মদ খেয়েচে। মেমদের কোমর ধরে নাচচে, ইংরিজি গান করচে। সহিস ভজা মুচি উর্দি পরে মদ পরিবেশন করচে। নীলকুঠিতে কোনো অবাঙালি চাকর বা খানসামা নেই। এইসব আশপাশের গ্রামের মুচি, বাগদি, ডোম শ্রেণীর লোকেরা চাকর-খানসামার কাজ করে। ফলে সাহেব মেম সকলেই বাংলা বলতে পারে, হিন্দি কেউ বলেও না, জানেও না।
আমিন প্রসন্ন চক্রবর্তী বার-দেউড়িতে তাঁর ছোট কুঠুরিতে বসে তামাক টানছিলেন। সামনে বসে ছিল বরদা বাগদিনী। বরদার বয়স প্রসন্ন চক্রবর্তীর চেয়ে বেশি, মাথার চুল শণের দড়ি। বরদাকে প্রসন্ন। চক্রবর্তী মাঝে মাঝে স্মরণ করেন নিজের কাজ উদ্ধারের জন্যে।
প্রসন্ন বললেন–গয়া ভালো আছে?
–তা একরকম আছে আপনাদের আশীর্বাদে।
–বড় ভালো মেয়ে। এমন এ দিগরে দেখি নি। একটা কথা বরদা দিদি
–কি বলো–
–এক বোতল ভালো বিলিতি মাল গয়াকে বলে আনিয়ে দাও দিদি। আজ অনেক ভালো জিনিসের আমদানি হয়েচে। সায়েব-সুবোর খানা, বুঝতেই পারচো। অনেক দিন ভালো জিনিস পেটে পড়ে নি—
–সে বাপু আমি কথা দিতে পারবো না। গয়া এখন ইদিকি নেই–সায়েবদের খানার সময় গয়া সেখানে থাকে না–
-লক্ষ্মী দিদি, শোনবো না, একটু নজর করতিই হবে–উঠে যাও দিদি। দ্যাখো, যদি গয়াকে বলে নিদেনে একটা বোতল যোগাড় করতি পারো
বরদা বাগদিনী চলে গেল। এ অঞ্চলে বরদার প্রতিপত্তি অসাধারণ, কারণ ও হল সুবিখ্যাত গয়ামেমের মা। গয়ামেমকে মোল্লাহাটি নীলকুঠির অধীন সব গ্রামের সব প্রজা জানে ও মানে। গয়া বরদা বাগদিনীর মেয়ে বটে, কিন্তু বড়সাহেবের সঙ্গে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা, এইজন্যেই ওর নাম এ অঞ্চলে গয়ামেম।
গয়া খারাপ লোক নয়, ধরে পড়লে সাহেবকে অনুরোধ করে। অনেকের ছোটবড় বিপদ সে কাটিয়ে দিয়েছে। মেয়েমানুষ কিনা, পাপপথে নামলেও ওর হৃদয়ের ধর্ম বজায় আছে ঠিক। গয়ার বয়স বেশি নয়, পঁচিশের মধ্যে, গায়ের রং কটা, বড় বড় চোখ, কালো চুলের ঢেউ ছেড়ে দিলে পিঠ পর্যন্ত পড়ে, মুখখানা বড় ছাঁচের কিন্তু এখনো বেশ টুলটুলে। সর্বাঙ্গের সুঠাম গড়নে ও অনেক ভদ্রঘরের সুন্দরীকে হার মানায়। পথ বেয়ে হেঁটে গেলে ওর দিকে চেয়ে থাকতে হয় খানিকক্ষণ।
গয়ামেমকে কিন্তু বড়সাহেবের সঙ্গে কেউ দেখে নি। অথচ ব্যাপারটা এ অঞ্চলে অজানা নয়। সে হল বড়সাহেবের আয়া, সর্বদা থাকে হলদে কুঠিতে, যেটা বড়সাহেবের খাস কুঠি। ফর্সা কালাপেড়ে শাড়ি ছাড়া সে পরে না, হাতে পৈঁছে, বাজুবন্ধ, কানে বড় বড় মাকড়ি-ঘন বনের বুকচেরা পাহাড়ি পথের মতো বুকের খাঁজটাতে ওর দুলছে সরু মুড়কি-মাদুলি, সোনার হারে গাঁথা।
ডোম-বাগদির মেয়েরা বলে–গয়া দিদি এক খেলা দেখালো ভালো! ওদের মধ্যে ভালো ঘরের ঝি-বৌয়েরা নাক সিটকে বলে–অমন। পৈঁছে বাজুবন্ধের পোড়া কপাল!
নিশ্চয় ওদের মধ্যে অনেকে ঈর্ষা করে ওকে। এর প্রমাণও আছে। অনেকে প্রতিযোগিতায় হেরেও গিয়েচে ওর কাছে। ঈর্ষা করবার সঙ্গত কারণও আছে বৈ কি!
আমিন প্রসন্ন চক্কত্তির ঘরে এহেন গয়ামেমের আবির্ভাব খুবই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। প্রসন্ন চক্কত্তি চমকে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন–এই যে গয়া। এসো মা এসো–বসতি দিই কোথায়—
গয়া হেসে বললে–থা খুড়োমশাই–আমি ঝঙ্কাঠের ওপর বসচি–তারপর কি বললেন মোরে?
–একটা বোতল যোগাড় করে দিতি পারো মা?
–দেখুন দিকি আপনার কাণ্ড। মা গিয়ে মোরে বললে, দাদাঠাকুরকে একটা ভালো বোতল না দিলি নয়। এই দেখুন আমি এনিচি কেমনধারা দেখুন তো?
গয়া কাপড়ের মধ্যে থেকে একটা সাদা পেটমোটা বেঁটে বোতল বার করে প্রসন্ন চক্কত্তির সামনে রাখলো। প্রসন্ন চক্কত্তির ছোট ছোট চোখ দুটো লোভে ও খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বোতলটা ধরে বললে–আহা, মা আমার–দেখি দেখি–কি ইংরিজি লেখা রয়েছে পড়তে পারিস?
–না খুড়োমশায়, ইঞ্জিরি-ফিঞ্জিরি আমরা পড়তি পারি নে।
প্রসন্ন চক্কত্তি গয়ার দিকে প্রশংসমান দৃষ্টিতে চাইলেন। কিঞ্চিত মুগ্ধ দৃষ্টিতেও বোধ হয়। গয়ামেমের সুঠাম যৌবন অনেকেরই কামনার বস্তু। তবে বড় উঁচু ডালের ফল, হাতের নাগালে পাওয়া সকলের ভাগ্যে ঘটে কি?
প্রসন্ন চক্কত্তি বললে–হাঁরে গয়া, সাহেব মেমের নাচের মধ্যি হোলো কি? দেখেচিস কিছু?