–oh, the sucking pig is the best.-পাঁচ মাসের বাচ্চা বড় হোলো। মাই খায় এমন বাচ্চা দিতে পারব না তুমি?
–না, তেমন নেই সায়েব। এত ছোট বাচ্চা কনে পাবো?
–জেলা থেকে হাকিম আসচে, এখানে খাবে। বাচ্চা হলি খাবার জুত হোত।
–এবার হলি রেখে দেবো। সায়েব, সেলাম। মুই চল্লাম। পেরনাম হই দেওয়ানজি।
রাজারাম সাহেবকে দেখেই বুঝেছিলেন একটা গুরুতর ব্যাপারের খবর নিয়ে সে এখানে এসেচে। তিনকড়ি বিদায় নেবার পরক্ষণেই তিনি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন–কি হয়েচে সায়েব?
-খুব গোলমাল। রসুলপুর আর রাহাতুনপুরির মুসলমান চাষীরা ক্ষেপে উঠেছে নীল বুনবে না।
–কে বললে?
কারকুন গিয়েছিল নীলির দাগ মারতি তারা দাগ মারতি দেয় নি, লাঠি নিয়ে তাড়া করেচে
–এতবড় আস্পদ্দা তাদের?
–তুমি ঘোড়া আনতি বলো। চলো দুজনে ঘোড়া করে সেখানে _ যাবো। বড়সাহেবকে কিছু বলো না এখন।
–যদি সত্যি হয় তখন কি করা যাবে সে আমাকে বলতি হবে। না সায়েব। আপনি দয়া করে শুধু ফজদুরি মামলা থেকে আমারে বাঁচাবেন।
-না না, তুমি বড় rash, কিছু করে বসবা। ওই জন্যি তোমারে আমার বিশ্বেস হয় না।
একটু পরে দুটো ঘোড়ায় চড়ে দুজনে বেরিয়ে গেল। কখন দেওয়ান ফিরে এসেছিলেন কেউ জানে না। পরদিন সকালে চারিধারে খবর রটে গেল রাত্রে রাহাতুনপুর গ্রাম একেবারে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েচে। বড় বড় চাষীদের গ্রাম, কারো বাড়ি বিশ-ত্রিশটি পর্যন্ত ধানের গোলা ছিল–আর ছিল ছচালা আটচালা ঘর, সব পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েচে। কি ভাবে আগুন লেগেছিল কেউ জানে না, তবে সন্ধ্যারাত্রে ছোটসাহেব এবং দেওয়ানজি রাহাতুলপুরের মোড়লের বাড়ি গিয়েছিলেন; সেখানে প্রজাদের ডাকিয়ে নীল বুনবে না কেন তার কৈফিয়ৎ চেয়েছিলেন। তারা রাজি হয় নি। ওঁরা ফিরে আসেন রাত এগারোটার পর। শেষরাত্রে গ্রামসুদ্ধ আগুন লেগে ছাইয়ের ঢিবিতে পরিণত হয়েচে। এই দুই ব্যাপারের মধ্যে কার্যকরণ-সম্পর্ক বিদ্যমান বলেই সকলে সন্দেহ করচে।
পরদিন জেলা-ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ডঙ্কিনসন নীলকুঠির বড় বাংলোতে সদলবলে এসে পৌঁছুলেন। তিনি যখন কুঠির ফিট গাড়ী থেকে নামলেন, তখন শুধু বড়সাহেব ও ছোটসাহেব সদর ফটকে তাঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে উপস্থিত ছিলেন–দেওয়ান রাজারাম নাকি চুরুটের বাক্স এগিয়ে দেওয়ার জন্যে উপস্থিত ছিলেন বৈঠকখানার টেবিলের পাশে। ডঙ্কিন্স এসেছিলেন শুধু নীলকুঠির আতিথ্য গ্রহণ করতে নয়, বড়সাহেব একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ম্যাজিষ্ট্রেটকে এখানে এনেছিলেন।
রাজারামকে ডেকে বড়সাহেব বললেন–টুমি কি ডেখিলে ইহাকে বলিটে হইবে। ইনি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আছে–this man is our Dewan, Mr. Duncinson, and a very shrewd old man too go on, বলিয়া যাও–রাহাটুনপুরে কি ডেখিলে–
রাজারাম আভূমি সেলাম করে বললেন–সায়েব, ওরা ভয়ানক চটেচে। লাঠি নিয়ে আমাকে মারে আর কি! নীল কিছুতেই বুনবে না। আমি কত কাকুতি করলাম–হ্যাঁতে-পায়ে ধরতে গেলাম। বললাম
ডঙ্কিনসন সাহেব বড়সাহেবের দিকে চেয়ে বললেন–What he did, he says?
-Entreated them,
-I understand. Ask him how many people were there
–কটো লোক সেখানে ছিল?
–তা প্রায় দুশো লোক সায়েব। সব লাঠিসোঁটা নিয়ে এসেছিল–
-Came with lathis and other weapons.
-Oh, they did, did they? The scoundrels!
–টারপরে টুমি কি করিলে?
–চলে এলাম সায়েব। দুঃখিত হয়ে চলে এলাম। ভাবতি ভাবতি এলাম, এতগুলো নীলির জমি এবার পড়ে রইলো। নীলচাষ হবে না। কুঠির মস্ত লোকসান।
কিছুক্ষণ পরে সদর-কুঠির সামনের মাঠ জনতায় ভরে গেল। ওরা এসেচে ম্যাজিষ্ট্রেট সায়েবের কাছে নালিশ জানাতে–দেওয়ানজি ওদের গ্রাম রাহাতুনপুর একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে এসেছেন।
ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ান রাজারামকে ডেকে পাঠালেন। বললেন–টুমি কি করিয়াছে? আগুন ডিয়াছে?
রাজারাম আকাশ থেকে পড়লেন। চোখ কপালে তুলে বললেন– আগুন! সে কি কথা সায়েব! আগুন!
আগুন জিনিসটা কি তাই যেন তিনি কখনো শোনেন নি।
ম্যাজিষ্ট্রেটের সন্দেহ হল তিনি রাজারামকে অনেকক্ষণ জেরা করলেন। ঘুঘু রাজারাম অমন অনেক জেরা দেখেছেন, ওতে তিনি ভয় পান না। রাহাতুনপুর গ্রামের লোকদের অনেককে ডাক দিলেন, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কিন্তু কুঠির সীমানায় দাঁড়িয়ে ওরা বেশি কিছু বলতে ভয় পেলে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আজ এসেছে, কাল চলে যাবে, কিন্তু ছোটসাহেব আর দেওয়ানজি চিরকালের জুজু। বিশেষত দেওয়ানজি। ওঁদের সামনে দাঁড়িয়ে ওঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়া–সে অসম্ভব। রাহাতুনপুর গ্রামে ম্যাজিষ্ট্রেট স্বয়ং গেলেন দেখতে। সঙ্গে বড়সাহেব ও ছোটসাহেব। মস্ত বড় হাতী তৈরি হল তাঁদের যাবার জন্যে দু-দুটো। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। রাহাতুনপুরের মাঠ।
খুব বড় গ্রাম নয় রাহাতুনপুর, একপাশে খড়ের মাঠ, খড়ের মাঠের পূর্বদিকে এই গ্রামখানি–একখানাও কোঠাবাড়ী ছিল না। চাষী গৃহস্থদের খড়ের চালাঘর গায়ে গায়ে লাগা। পুড়ে ভস্মসাৎ হয়ে গিয়েচে। কোনো কোনো ভিটেতে পোড়া কালো বাঁশগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মাটির দেওয়াল পুড়ে রাঙ্গা হয়ে গিয়েচে, কুমোর বাড়ীর হাঁড়ি পোড়ানো পনের মত দেখতে হয়েচে তাদের রং। কবীর শেখের গোয়ালে দুটো দামড়া হেলে গোরু পুড়ে মরেচে। প্রত্যেকের উঠানে আধ-পোড়া ধানের গাদা, পোড়া ধানের গাদা থেকে মেয়েরা কুলো করে ধান বেছে নিয়ে ঝাড়ছিল–মুখের ভাত যদি কিছুটা বাঁচাতে পারা যায়।