–আপনি না বাঁচালি বাঁচবো না। মুরুক্ষু মানুষ, করে ফেলেছি এক কাজ। ক্ষ্যামা দ্যান বাবু। আপনি মা-বাপ।
–আচ্ছা, এবার সোজা হয়ে এসো। তোমার জমি ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু
–বাবু সে আমায় বলতি হবে না। আপনার মান রাখতি মুই জানি।
–যাও, জমি ছেড়ে দিলাম। কাল আমিনবাবু গিয়ে ঠিক করে আসবে। তবে মার্কা-তোলার মজুরিটা জরিপের কুলিদের দিয়ে দিও। যাও–
নবু গাজি আভূমি সেলাম করলে পুনরায়। চলে গেল সে কাঁটপোড়ার বাঁওড়ের ধারে ধারে। দেওয়ান রাজারাম রায় ও সদর আমিন প্রসন্ন চক্কত্তির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
এই রকমই চলচে এদের শাসন অনেকদিন থেকে। বড়সাহেব ছোটসাহেব যদি বা ছাড়ে, এরা ছাড়ে না। চাষীদের, সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত গৃহস্থদের ভালো ভালো জমিতে মার্কা দিয়ে আসে, সে জমিতে নীল পুঁততেই হবে। না পুঁতলে তার ব্যবস্থা আছে।
বড়সাহেব এ অঞ্চলের ফৌজদারি বিচারক। সপ্তাহে তিন দিন নীলকুঠিতে কোর্ট বসে। গোরু চুরি, ধান চুরি, মারামারি, দাঙ্গাহাঙ্গামার অভিযোগের বিচার হবে এখানেই। বড় কুঠির সাদাঘরে এ সময় নানা গ্রাম থেকে মামলা রুজু করতে লোক আসে। তেমাথার মোড়ে সনেকপুরের মাঠে একটা ফাঁসিকাঠ টাঙানো হয়েচে সম্প্রতি। রাজারামু বলে বেড়াচ্ছেন চারিদিকে যে এবার বড়সায়েব ফাঁসির হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েচেন। গভনমেন্ট থেকে।
বড়সাহেব কিন্তু সুবিচারক। খুব মন দিয়ে উভয় পক্ষ না শুনে বিচার করে না। রায় দেবার সময় ভেবে দ্যায়। অপরাধীর কম, লঘুপাপে গুরুদণ্ড সর্বদাই লেগে আছে। নীলকুঠির কাজের একটু শ্রুতি হলে স্বয়ং দেওয়ানেরও নিষ্কৃতি নেই। তবু ছোটসাহেবের চেয়ে বড়সাহেবকে পছন্দ করে লোকে। দেয়ানকে বলে– টোমাকে চুনের প্রডামে পুরিয়া রাখিলে তুমি জড় হইবে।
রাজারাম বলেন–আপনার ইচ্ছা হুজুর। আপনি করলি সব করাত পারেন।
-You have a very oily tongue I know, but that wouldnt cut ice ihis time–টোমাকে আমি জবড করিটে জানে।
–কেন জানবেন না হুজুর। হুজুর মা-বাবা
–মা-বাবা! মা-বাবা! চুনের গুড়ামে পুরিলে টোমার জড ঠিক হইয়া যাইবে।
–হুজুরের খুশি।
–যাও, ডশ টাকা জরিমানা হইল।
–যে আজ্ঞে হুজুর।
রাজারামের কাজ এ ভাবেই চলে।
.
কুঠিতে জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট বাহাদুর আসবেন। দেওয়ান রাজারাম ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন আজ সকাল থেকে। ভেড়া, মাছ, ভালো আম ও ঘি যোগাড় করবার ভার তাঁর ওপর। মাঝে মাঝে এ রকম লেগেই আছে, সাহেব-সুবো অতিথি যাতায়াত করচে মাসে দুবার তিনবার!
মুড়োপাড়ার তিনকড়িকে ডাকিয়ে এনেছেন তার একটি নধর শূওরের জন্যে। তিনকড়ি জাতে কাওরা, শূওরের ব্যবসা করে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেচে। দোতলা কোঠাবাড়ি, লোকজন, ধানের গোলা, পুকুর। অনেক ব্রাহ্মণ কায়স্থ তাকে খাতির করে চলে। রাজারামকে উপহার দেওয়ার জন্যে সে বাড়ি থেকে ঘানি-ভাঙ্গা সর্ষের তেল এনেছিল প্রায় দশ সের, কিন্তু রাজারাম তা ফেরত দিয়েছেন, কাওরার দেওয়া জিনিস তাঁর ঘরে ঢুকবে না।
তিনকড়ি বললে–একটা আছে পাঁচ মাসের আর একটা আছে দু বছরের। যেটা পছন্দ করেন বলে দেবেন। তবে বলতি নেই, আপনারা ওর সোয়াদ জানেন না, দেওয়ানবাবু, একবার খেলি আর ভুলতি পারবেন না। ওই পাঁচ মাসের বাচ্চাড়া শুধু ভেজি খাবেন ঘি দিয়ে–
রাজারাম হেসে বললেন– দূর ব্যাটা, কি বলে। বামুনদের অমন বলতি আছে? তোদের পয়সা হলি কি হবে, জাতের স্বধম্মো যাবে কোথায়?
–বাবু, ঐ যা! আপনারা যে খান না, সে কথা ভুলে গিইচি, মাপ করবেন।
-না না, তোর কথায় আমার রাগ হয় না। তা হলি শূওরের সরবরাহ করতি হবে তোমাকেই, এই মনে রাখবা।
–মনে রাখারাখি কি, কালই আমি পাঁচ মাসের বাচ্চা আর দুবছরেরডা পেঠিয়ে দেবো এখন। কোথায় পেঠিয়ে দেবো বলুন, এখানেই আপনার বাড়ি আমার নোকে নিয়ে আসবে?
-না না, আমার বাড়ি কেন? কুঠিতে পাঠিয়ে দেবা। ব্রাহ্মণের বাড়ি শূওর? ব্যাটাকে কি যে করি–
তিনকড়ি বিদায় নেবার উদ্যোগ করতেই রাজারাম বললেন– ব্রাহ্মণবাড়ি এসেচ, পেরসাদ না পেয়ে যাবে, না যেতি আছে? পয়সা হয়েচে বলে কি ধরাকে সরা দেখছো নাকি?
তিনকড়ি জিভ কেটে বললেও কথাই বলবেন না। বেরাহ্মণের পাত কুড়িয়ে খেয়ে মোরা মানুষ দেওয়ানজি। মুখ থেকে ফেলে দিলি সে ভাতও মাথায় করে নেবো। তবে মোর মনটাতে আজ আপনি বড় কষ্ট দেবেন।
–কেন, কেন?
–ভালো তেলটা এনেলাম আপনার জন্যি আলাদা করে, তেলডা নেলেন না।
–নিলাম না মানে, শুদুরের দান নিতি নেই আমাদের বংশে, সেজন্যে মনে দুঃখু করো না তিনকড়ি। আচ্ছা তুমি দুঃখিত হচ্চ, কিছু দাম দিচ্চি, নিয়ে তেলটা রেখে যাও
–দাম? কত দাম দেবেন?
–এক টাকা।
–তা হলে তো পাঁচসের তেলের দাম দিয়েই দেলেন কত্তা। মুই কি তেল বিক্রি করতি এনেলাম বাবুর কাছে? এটুদয়া করবেন না? আছিই না নয় ছোটনোক–
–না তিনকড়ি। মনে করো না সেজন্যি কিছু। একটা টাকাই তোমারে নিতি হবে। তার কম নিলি আমি পারব না। ওরে, কে আছিস। সীতেনাথ–বাবা ইদিকি তিনকড়ির কাছ থেকে তেলের ভাঁড়টা নাও
এই সময়ে ছোটসাহেব ব্যস্তসমস্ত হয়ে সেখানে এসে হাজির হল। রাজারামকে দেখে কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনকড়িকে দেখে থেমে গেল।
রাজারাম দাঁড়িয়ে উঠে বললেন–পাঁচ মাসের শূওরের বাচ্চা একটা যোগাড় করা গেল হুজুর