অথচ কত লোকের চিতারছাই ইছামতীর জল ধুয়ে নিয়ে গেল সাগরের দিকে, জোয়ারে যায় আবার ভাঁটায় উজিয়ে আসে, এমনি বারবার করতে করতে মিশে গেল দূর সাগরের নীল জলের বুকে। যে কত আশা করে কলাবাগান করেছিল উত্তর মাঠে, দোয়াড়ি পেতেছিল বাঁশের কঞ্চি চিরে বুনে ঘোলডুবরির বাঁকে, আজ হয়তো তাঁর দেহের অস্থি রোদবৃষ্টিতে সাদা হয়ে পড়ে রইল ইছামতীর ডাঙায়। কত তরুণী সুন্দরী বধূর পায়ের চিহ্ন পড়ে নদীর দুধারে, ঘাটের পথে, আবার কত প্রৌঢ় বৃদ্ধার পায়ের দাগ মিলিয়ে যায়..গ্রামে গ্রামে মঙ্গলশঙ্খের আনন্দধ্বনি বেজে ওঠে বিয়েতে, অন্নপ্রাশনে, উপনয়নে, দুর্গাপুজোয়, লক্ষ্মীপুজোয়…সে সব বধূদের পায়ের আলতা ধুয়ে যায় কালে কালে, ধূপের ধোঁয়া ক্ষীণ হয়ে আসে…মৃত্যুকে কে চিনতে পারে, গরীয়সী মৃত্যুমাতাকে? পথপ্রদর্শক মায়ামৃগের মতো জীবনের পথে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে, অপূর্ব রহস্যভরা তার অবগুণ্ঠন কখনো খোলে শিশুর কাছে, কখনো বৃদ্ধের কাছে…তেলাকুচো ফুলের দুলুনিতে অনন্তের সে সুর কানে আসে…কানে আসে বনৌষধির কটুতিক্ত সুঘ্রাণে, প্রথম হেমন্তে বা শেষ শরতে। বর্ষার দিনে এই ইছামতীর কূলে কূলে ভরা ঢলঢল রূপে সেই অজানা মহাসমুদ্রের তীরহীন অসীমতার স্বপ্ন দেখতে পায় কেউ কেউ, কত যাওয়া-আসার অতীত ইতিহাস মাখানো ঐ সব মাঠ, ঐ সব নির্জন ভিটের ঢিপি–কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়ের হাসি ওতে অদৃশ্য রেখায় আঁকা। আকাশের প্রথম তারাটি তার খবর রাখে হয়তো…
ওদের সকলের সামনে দিয়ে ইছামতীর জলধারা চঞ্চলবেগে বয়ে চলেচে বড় লোনা গাঙের দিকে, সেখান থেকে মোহানা পেরিয়ে, রায়মঙ্গল পেরিয়ে, গঙ্গাসাগর পেরিয়ে মহাসমুদ্রের দিকে।…