ওর মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল গয়া।
–কেমন আছ গয়া?
-ভালো আছি। আপনি কনে থেকে? আজকাল আছেন কনে?
–আছি অনেক দূর। বাহাদুরপুরি। কাছারিতে আমিনি করি। তুমি কেমন আছ তাই আগে কও শুনি। চেহারা এমন খারাপ হলো কেন?
–আর চেহারার কথা বলবেন না। খেতি পেতাম না যদি সায়েব সেই জমির বিলি না করে দিত আর আপনি মেপে না দেতেন। যদ্দিন। সময় ভালো ছেল, আমারে দিয়ে কাজ আদায় করে নেবে বুঝতো, তদ্দিন লোকে মানতো, আদর করতো। এখন আমারে পুঁচবে কেডা? উল্টে আরো হেনস্থা করে, একঘরে করে রেখেচে পাড়ায়–সেবার তো আপনারে বলিচি।
–এখনো তাই চলচে?
–যদ্দিন বাঁচবো, এর সুরাহা হবে ভাবচেন খুড়োমশাই? আমার জাত। গিয়েচে যে! একঘটি জল কেউ দেয় না অসুখে পড়ে থাকলি, কেউ উঁকি মেরে দেখে না। দুঃখির কথা কি বলবো। আমি একা মেয়েমানুষ, আমার জমির ধানডা লোকে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যায় রাত্তিরবেলা কেটে। কার সঙ্গে ঝগড়া করবো? সেদিন কি আমার আছে!
প্রসন্ন চত্তি চুপ করে শুনছিল। ওর চোখে জল। চাঁদ দেখা যাচ্চে গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে। কি খারাপ দিনের মধ্যে দিয়ে জীবন তার কেটে যাচ্ছে। তারও জীবনে ঠিক ওর মতোই দুর্দিন নেমেছে।
গয়া ওর দিকে চেয়ে বললে–আপনার কথা বলুন। কদ্দিন দেখি নি আপনারে। আপনার ঘোড়া পালালো খুড়োমশাই, বাঁধুন–
প্রসন্ন চক্কত্তি উঠে গিয়ে ঘোড়াটাকে ভালো করে বেঁধে এল বিলিতি গাছটার গায়ে। আবার এসে বসলো ওর পাশে। আজ যেন কত আনন্দ ওর মনে। কে শুনতে চায় দুঃখের কাহিনী? সব মানুষের কাছে কি বলা যায় সব কথা? এ যেন বড় আপন। বলেও সুখ এর কাছে। এর কানে পৌঁছে দিয়ে সব ভার থেকে সে যেন মুক্ত হবে।
বললেও প্রসন্ন। হেসে খানিকটা করে থেকে বললে-বুড়ো হয়ে গিইচি গয়া। মাথার চুল পেকেচে। মনের মধ্যি সর্বদা ভয়-ভয় করে। উন্নতি করবার কত ইচ্ছে ছিল, এখন ভাবি বুড়ো বয়েস, পরের চাকরি খোয়ালি কে একমুঠো ভাত দেবে খেতি? মনের বল হারিয়ে ফেলিচি। দেখচি যেমন চারিধারে, তোমার আমার রুক্ষু মাথায় একপলা তেল কেউ দেবে না, গয়া।
–কিছু ভাববেন না খুড়োমশাই। আমার কাছে থাকবেন আপনি। আপনার মেপে দেওয়া সেই ধানের জমি আছে, দুজনের চলে যাবে। আমারে আর লোকে এর চেয়ে কি বলবে? ডুবিচি না ডুবতি আছি। মাথার ওপরে একজন আছেন, যিনি ফ্যালবেন না আপনারে আমারে। আমার বাবা বড়র সন্ধান দিয়েছেন। আগে ভাবতাম কেউ নেই। চলুন আমার সঙ্গে খুড়োমশাই। যতদিন আমি আছি, এ গরিব মেয়ের সেবাযত্ন পাবেন আপনি। যতই ছোট জাত হই।
এক অপূর্ব অনুভূতিতে বৃদ্ধ প্রসন্ন চক্কত্তির মন ভরে উঠলে। তার বড় সুখের দিনেও সে কখনো এমন অনুভূতির মুখোমুখি হয় নি। সব হারিয়ে আজ যেন সে সব পেয়েছে এই জনশুন্য পোড়ো কবরখানায়। বসে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে উঠে বললে–আচ্ছা, চললাম গয়া।
গয়া অবাক হয়ে বললে–এত রাত্তিরি কোথায় যাবেন খুঁডোমশাই?
–পরের ঘোড়া এনিচি। রাত্তিরিই চলে যাবো কাছারিতে। পরের চাকরি করে যখন খাই, তখন তাদের কাজ আগে দেখতি হবে। না যদি আর দেখা হয়, মনে রেখো বুড়োটারে। তুমি চলে যাও, অন্ধকারে সাপ-খোপের ভয়।
আর মোটেই না দাঁড়িয়ে প্রসন্ন চক্কত্তি ঘোড়া খুলে নিয়ে রেকাবে পা দিয়ে লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠলো। ঘোড়ার মুখ ফেরাতে ফেরাতে অনেকটা যেন আপন মনেই বললে-মুখের কথা তো বললে গয়া, এই যথেষ্ট, এই বা কেডা বলে এ দুনিয়ায়, আপনজন ভিন্ন কেডা বলে? বড় আপন বলে যে ভাবি তোমারে
ষষ্ঠীর চাঁদ জুনিপার গাছের আড়াল থেকে হেলে পড়েছে মড়িঘাটার বাঁওড়ের দিকে। ঝিঁঝি পোকারা ডাকচে পুরোনো নীলকুঠির পুরোনো বিস্মৃত সাহেব-সুবোদের ভগ্ন সমাধিক্ষেত্রের বনেজঙ্গলে ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে।…
.
ইছামতীর বাঁকে বাঁকে বনে বনে নতুন কত লতাপাতার বংশ গজিয়ে উঠলো। বলরাম ভাঙ্গনের ওপরকার সোঁদালি গাছের ছোট চারাগুলো দেখতে দেখতে কয়েকবছরের মধ্যে ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়ে ওঠে, কত অনাবাদী পতিত মাঠে আগে গজালো ঘেঁটুবন, তারপর এল কাকজঙ্ঘা, কুঁচকাঁটা, নাটা আর বনমরিচের জঙ্গল, ঝোপে ঝোপে কত নতুন ফুল ফুটলো, যাযাবর বিহঙ্গকুলের মতো কি কলকূজন। আমরা দেখেছি জলিধানের ক্ষেতের ওপরে মুক্তপক্ষ বলাকার সাবলীল গতি মেঘপদবির ওপারে মৃণালসূত্র মুখে। আমরা দেখেছি বনশিমফুলের সুন্দর বেগুনি রং প্রতি বর্ষাশেষে নদীর ধারে ধারে।
ঐ বর্ষাশেষেই আবার কাশফুল উড়ে উড়ে জল-সরা কাদায় পড়ে বীজ পুঁতে পুঁতে কত কাশঝাড়ের সৃষ্টি করলো বছরে বছরে। কাশবন কালে সরে গিয়ে শেওড়াবন, সোঁদালি গাছ গজালো..তারপরে এল কত কুমুরে লতা, কাঁটাবাঁশ, বনচালতা। দুললো গুলঞ্চলতা, মটরফলের লতা, ছোট গোয়ালে, বড় গোয়ালে। সুবাসভরা বসন্ত মূর্তিমান হয় উঠলো। কতবার ইছামতীর নির্জন চরের ঘেঁটুফুলের দলে…সেই ফাল্গুন-চৈত্রে আবার কত মহাজনি নৌকা নোঙর করে বেঁধে খেল বনগাছের ছায়ায়, ওরা বড় গাং বেয়ে যাবে এই পথে সুন্দরবনে মোমমধু সংগ্রহ করতে, বেনেহার মধু, ফুলপাটির মধু, গেঁয়ো, গরান, সুন্দরি, কেওড়াগাছের নব প্রস্ফুটিত ফুলের মধু। জেলেরা সলা-জাল পাতে গলদা চিংড়ি আর ইটে মাছ ধরতে…
পাঁচপোতার গ্রামের দুদিকের ডাঙাতেই নীলচাষ উঠে যাওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গে বন্যেবুড়ো, পিটুলি, গামার, তিত্তিরাজ গাছের জঙ্গল ঘন হল, জেলেরা সেখানে আর ডিঙি বাঁধে না, অসংখ্য নিবিড় লতাপাতার জড়াজড়িতে আর সাঁইবাবলা, শেঁয়াকুল কাঁটাবনের উপদ্রবে ডাঙা দিয়ে এসে জলে নামবার পথ নেই, কবে স্বাতী আর উত্তরভাদ্রপদ নক্ষত্রের জল পড়ে ঝিনুকের গর্ভে মুক্তো জন্ম নেবে, তারই দুরাশায় গ্রামান্তরের মুক্তো-ডুবুরির দল জোংড়া আর ঝিনুক স্তূপাকার করে তুলে রাখে ওকড়াফলের বনের পাশে, যেখানে রাধালতার হলুদ রঙের ফুল টুপটাপ করে ঝরে ঝরে পড়ে ঝিনুকরাশির ওপরে।