বড় মোড়ল আবদুল লতিফ মারা গিয়েচে, তার ছেলে সামসুল এসে প্রসন্ন চক্কত্তিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। বেলা এখনো দণ্ড দুই আছে। বড় রোদে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা হয়েচে।
সামসুল বললে–সালাম, আমিনমশায়! আজকাল কনে আছেন?
–তোমাদের সব ভালো? আবদুল বুঝি মারা গিয়েচে? কদ্দিন? আহা, বড় ভালো লোক ছিল। আমি আছি বাহাদুরপুরি। বড় দূর পড়ে গিয়েচে, কাজেই আর দেখাশুনো হবে কি করে বলো।
–তামাক খান। সাজি।
–নকুড় কাপালী কোথায় আছে জানো? তাকে পাই কোথায়?
-বাঁওড়ের ধারে যে খড়ের চালা আছে, জরিপির সময় আমিনের বাসা হয়েল, সেখানে আছেন। ঠেকোয়।
প্রসন্ন চত্তি অনেকক্ষণ থেকে কিন্তু একটা কথা ভাবছে। পুরোনো কুঠিটা আবার দেখতে ইচ্ছে করে।
বেলা পড়ে এসেচে। সন্ধ্যার দেরি নেই। মোল্লাহাটির নীলকুঠি এখান থেকে তিন ক্রোশ পথ। ঘোড়া ছুটিয়ে গেলে এক ঘণ্টা। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবে ঘোড়া। খানিক ভেবেচিন্তে ঘোড়ায় চড়ে সে রওনা হল মোল্লাহাটি। অনেকদিন সেখানে যায় নি। বঁধুল বনে হলদে ফুল ফুটেচে, জিউলি গাছের আঠা ঝরচে কাঁচা কদমার শাকের মতো। হু-হু হাওয়া ফাঁকা মাঠের ওপার থেকে মুড়িঘাটার বাঁওড়ের কুমুদ ফুলের গন্ধ বয়ে আনচে। শেঁয়াকুল কাঁটার ঝোপে বেজি খসখস করচে পথের ধারে।
জীবনটা ফাঁকা, একদম ফাঁকা। মড়িঘাটার এই বড় মাঠের মতো। কিছু ভালো লাগে না। চাকরি করা চলচে, খাওয়াদাওয়া চলচে, সব যেন কলের পুতুলের মতো। ভালো লাগে না। করতে হয় তাই করা। কি যেন হয়ে গিয়েচে জীবনে।
সন্ধ্যা হল পথেই। পঞ্চমীর কাটা চাঁদ কুমড়োর ফালির মতো উঠেছে পশ্চিমের দিকে। কি কড়া তামাক খায় ব্যাটারা! ওই আবার দেয় নাকি মানুষকে খেতে? কাশির ধাক্কা এখনো সামলানো যায় নি।
দিগন্তের মেঘলা-রেখা বন-নীল দূরত্বে বিলীন। অনেকক্ষণ ঘোড়া চলেচে। ঘেমে গিয়েচে ঘোড়ার সর্বাঙ্গ। এইবার প্রসন্ন চক্কত্তির চোখে পড়লো দূরে উঁচু সাদা নীলকুঠিটা দীর্ঘ দীর্ঘ ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে। প্রসন্ন আমিনের মনটা ফুলে উঠলো। তার যৌবনের লীলাভূমি, তার কতদিনের আমোদ-প্রমোদ ও আড্ডার জায়গা, কত পয়সা হাতফেরতা। হয়েচে ওই জায়গায়। আজকাল নিশাচরের আড়া। লালমোহন পাল ব্যবসায়ী জমিদার, তার হাতে কুঠির মান থাকে?
প্রসন্ন চক্কত্তির হঠাৎ চমক ভাঙ্গলো। সে রাস্তা ভুল করে এসে পড়েচে কুঠি থেকে কিছুদূরের গোরস্থানটার মধ্যে। দুপাশে ঘন ঘন বাগান, বিলিতি কি সব বড় বড় গাছ রবসন্ সাহেবের আমলে এনে পোঁতা হয়েছিল, এখন ঘন অন্ধকার জমিয়ে এনেচে গোরস্থানে। ওইটে রবসন্ সাহেবের মেয়ের কবর। পাশে ওইটে ডানিয়েল সাহেবের। এসব সাহেবকে প্রসন্ন চক্কত্তি দেখে নি। নীলকুঠির প্রথম আমলে রবসন্ সাহেব ঐ বড় সাদা কুঠিটা তৈরি করেছিল গল্প শুনেচে সে।
কি বনজঙ্গল গজিয়েচে কবরখানার মধ্যে। নীলকুঠির জমজমাটের দিনে সাহেবদের হুকুমে এই কবরখানা থেকে সিঁদুর পড়লে তুলে নেওয়া যেতো, আর আজকাল কেই বা দেখচে আর কেই বা যত্ন করচে এ জায়গার?
ঘোড়াটা হঠাৎ যেন থমকে গেল। প্রসন্ন চক্কত্তি সামনের দিকে তাকালে, ওর সারা গা ডোল দিয়ে উঠলো। মনে ছিল না, এইখানেই আছে শিপটন সাহেবের কবরটা। কিন্তু কি ওটা নড়চে সাদা মতন? বড়সাহেব শিপটননের কবরখানায় লম্বা লম্বা উলুখড়ের সাদা ফুলগুলোর আড়ালে?
নির্জন কুঠির পরিত্যক্ত কবরখানা, অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় ঢাকা। প্রেত যোনির ছবি স্বভাবতই মনে না এসে পারে না, যতই সাহসী হোক আমিন প্রসন্ন চক্রবর্তী। সে ভীতিজড়িত আড়ষ্ট অস্বাভাবিক সুরে বললে–কে ওখানে? কে ও? কে গা?
শিপটন্ সাহেবের সমাধির উলুখড়ের ফুলের ঢেউয়ের আড়াল থেকে একটি নারীমূর্তি চকিত ও ত্রস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে রইল অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় পাথরের মূর্তিরই মতো।
–কে গা? কে তুমি?
–কে? খুড়োমশাই! ও খুড়োমশাই!
ওর কণ্ঠে অপরিসীম বিস্ময়ের সুর। আরো এগিয়ে এসে বললে– আমি গয়া।
প্রসন্নর মুখ দিয়ে খানিকক্ষণ কোনো কথা বার হল না বিস্ময়ে। সে তাড়াতাড়ি রেকাবে পা দিয়ে নেমে পড়লো ঘোড়া থেকে, আহ্লাদের সুরে বললে–গয়া! তুমি! এখানে? চলো চলো, বাইরে চলো এ জঙ্গল থেকে–এখানে কোথায় এইছিলে?
জ্যোৎস্নায় প্রসন্ন দেখলে গয়ার চোখের কোণে জলের রেখা। এর আগেই সে কাঁদছিল ওখানে বসে বসে এইরকম মনে হয়। কান্নার চিহ্ন ওর চোখেমুখে চিকচিকে জ্যোৎস্নায় সুস্পষ্ট।
প্রসন্ন চক্কত্তি বললে–চলো গয়া, ওইদিকে বার হয়ে চলো–এঃ, কি ভয়ানক জঙ্গল হয়ে গিয়েচে এদিকটা।
গয়ামেম ওর কথায় ভালো করে কর্ণপাত না করে বললে–আসুন। খুললামশাই, বড়সায়েবের কবরটা দেখবেন না? আসুন। আলেন যখন, দেখেই যান–
পরে সে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। শিপটনের সমাধির ওপর টাটকা সন্ধ্যামালতী আর কুঠির বাগানের গাছেরই বকফুল ছড়ানো। তা থেকে এক গোছা সন্ধ্যামালতী তুলে নিয়ে ওর হাতে দিয়ে বললে– দ্যান, ছড়িয়ে দ্যান। আজ মরবার তারিখ সাহেবের, মনে আছে না? কত নুনডা খেয়েছেন একসময়। দ্যান, দুটো উলুখড়ের ফুলও দ্যান তুলে টাটকা। দ্যান ওইসঙ্গে–
প্রসন্ন চক্কত্তি দেখলে ওর দুগাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে নতুন করে।
তারপর দুজনে কবরখানার ঝোপজঙ্গল থেকে বার হয়ে একটা বিলিতি গাছের তলায় গিয়ে বসলো। খানিকক্ষণ কারো মুখে কথা নেই। দুজনেই দুজনকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখে বেজায় খুশি যে হয়েচে, সেটা ওদের মুখের ভাবে পরিস্ফুট। কত যুগ আগেকার পাষাণপুরীর ভিত্তির গাত্রে উৎকীর্ণ কোনো অতীত সভ্যতার দুটি নায়কনায়িকা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেচে আজ এই সন্ধ্যরাতে মোল্লাহাটির পোড়ো নীলকুঠিতে রবসন সাহেবের আনীত প্রাচীন জুনিপার গাছটার তলায়। গয়া রোগা গয়ে গিয়েচে, সে চেহারা নেই। সামনের দাঁত পড়ে গিয়েচে। বুড়ো হয়ে আসচে। দুঃখের দিনের ছাপ ওর মুখে, সারা অঙ্গে, চোখের চাউনিতে, মুখের ম্লান হাসিতে।