রাজারাম পূর্বে একবার সেলাম করেছেন, তখন সাহেব দেখতে পান। নি ভেবে আর একবার লম্বা সেলাম করলেন। জিভ শুকিয়ে আসচে তার। ছোটসাহেবের মতো দিলখোলা লোক নয় ইনি। মেজাজ বেজায় গম্ভীর, দুর্দান্ত বলেও খ্যাতি যথেষ্ট। না-জানি কখন কি করে বসে। সাহেবসুবো লোককে কখনো বিশ্বাস করতে নাই। ভালো ছিল সেই ছবি আঁকিয়ে পাগলা সাহেবটা। তিলুর ও ভবানী ভায়ার ছবি এঁকেছিল লুকিয়ে। যাবার সময় সেই কথার উল্লেখ করে রাজারাম পাগলা সাহেবটার কাছে পঁচিশ টাকা বকশিশ আদায় করেও নিয়েছিলেন। অবিশ্যি ভবানী তার কিছু জানে না। যেমন সেই পাগলা সাহেব, তেমনি ভবানী, দুই-ই সমান। আপন-খেয়ালমতো চলে দুজনেই।
রাজারাম বললেন–আপনার আশীর্বাদে হুজুর ভালোই আছি।
–কি ডরকার আছে এখানে? বিশেষ কোনো কাজ আছে? আমি এখন খুব বিজি আছি। সময় কম আছে।
–অন্য কিছু না হুজুর। আমি তেঘরার একটা প্রজার জমিতে দাগ মেরেছিলাম, ছোটসায়েব তাকে মাপ করে দিয়েচেন।
শিপটন ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন–যা হুকুম ডিয়াছেন, টাহাই হইবে। ইহাটে টোমার কি অমান্য আছে।
বড়সাহেব এমন উল্টোপাল্টা কথা বলে, ভালো বাংলা না জানার দরুন। ভালো বালাই সব! রাজারামের হয়েচে মহাপাপ, এইসব অদ্ভুত চিজ নিয়ে ঘর করা। সাহেবের ভুল সংশোধন করে দেওয়া চলবে না, চটে যাবে। বালাইয়ের দল যা বলে তাই সই। তিনি বললেন–আজ্ঞে না, অন্যায় আর কি আছে? তবে এমন করলে প্রজা শাসন করা যায়।
–কি হবে না?
–প্রজা জব্দ করা যাবে না। নীলের চাষ হবে না হুজুর।
–নীলের চাষ হবে না টবে টোমাকে কি জন্য রাখা হইল?
–সে তো ঠিক হুজুর। আমাকে প্রজাদের সামনে অপমান করা হলে আমার কাজ কি করে হয় বলুন হুজুর
অপমান? ওহো, ইউ আর ইন্ ডিসগ্রেস ইউ ওল্ড স্কাউন্ডেল, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। টোমাকে কি করিটে হইবে?
–আপনি বুঝুন হুজুর। নবু গাজি বলে একজন বদমাইশ প্রজার। জমিতে দাগ মেরেছিলাম, উনি হুকুম দিয়েচেন জমি ছেড়ে দিতে। ও গাঁয়ে আর কোনো জমিতে হাত দেওয়া যাবে না। নীলের চাষ হবে কি করে?
–কটো জমি এ বছর ডাগ দিয়াছ, আমাকে কাল ডেখাটে হইবে। ইমপ্রেশন্ রেজিস্টার টৈরি করিয়াছ?
–হাঁ হুজুর।
–যাও। না ডেখাইতে পারিলে জরিমানা হইবে। কাল লইয়া আসিবে।
বাস, কাজ মিটে গেল। প্রসন্ন চক্কত্তির কাছে মুখ ভারি করে ফিরে গেলেন রাজারাম।–না কিছুই হোলো না। ওরা নিজের জাতের মান অপমান আগে দেখে। পাজি শূওরখোর জাত কিনা। তোমার আমার অপমানে ওদের বয়েই গেল।
প্রসন্ন চক্কত্তি ঘুঘু লোক। আগেই জানতেন কি হবে। তামাক টানতে টানতে বললেন–অপমানং পুরস্কৃত্য মানং কৃত্ব চ পৃষ্টকে–ছেলেবেলায় চাণক্যশ্লোকে পড়েছিলাম দেওয়ানজি। ওদের কাছে এসে মান-অপমান দেখতে গেলে চলবে না। তা যান, আপনি আপনার কাজে যান–
–আবার উল্টে জরিমানার ব্যবস্থা
–সে কি! জরিমানা করে দিলে নাকি?
–সেজন্যে জরিমানা নয়। দাগের খতিয়ান হাল সনের তৈরি হয়েচে কি না, কাল দেখাতি হবে, না দেখাতি পারলে জরিমানা করবে।
–ভালো। ওদের অমনি বিচার।
–উল্টে কচু গালে লাগলো–
রাজারাম অপ্রসন্ন মুখে বার হয়ে গিয়ে দেখলেন নবু গাজি দলবল নিয়ে সদর ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে কারকুন রামহরি তরফদারের সঙ্গে একগাল হেসে কি বলচে। রাজারামকে সে এখনো বুঝতে পারে নি। স্বয়ং সাহেবও বোঝেন না। রাজারাম গম্ভীর স্বরে হাঁক দিয়ে বললেন–এই নবু গাজি, ইদিকি শুনে যাও।
নবু গাজির হাসি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সে আজকের ব্যাপার নিয়ে হাসছিল না। সে সাহস তার নেই। তার একটা গোরু চুরি করে নিয়ে গিয়ে তারই জনৈক অসাধু কৃষাণ নহাটার হাটে বিক্রি করে, কি ভাবে সেই গোরুটা আবার নবু গাজি উদ্ধার করেছিল, তারই গল্প ফেঁদে নিজের কৃতিত্ত্বে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসছিল সে। রাজারামের স্বরে তাঁর প্রাণ উবে গেল। তাড়াতাড়ি এসে সামনে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সুরে বললে–কি বাবু?
–যে জমিতে দাগ মেরেচি, সেটাতেই নীলের চাষ হবে। বুঝলে?
নবু গাজি বিস্ময়ের সুরে বললে–সে কি বাবু, ছোটসায়েব যে বললেন–
–ছোটসায়েব বলেচেন বলেচেন। বাবার ওপরে বাবা আছে। এই বড়সায়েবের হুকুম। এই আমি আসছি বড়সায়েবের দপ্তর থেকে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া চলে না, বুঝলে নবু গাজি? তোমাকে নীলকুঠির চুনের গুদোমে পুরে ধান খাওয়াবো, তবে আমার নাম রাজারাম চৌধুরী, এই তোমায় বলে দিলাম। তুমি যে কি রকম– তোমার ভিটেতে ঘুঘু যদি না চরাই
নবু গাজি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। দেওয়ান রাজারামকে ভয় করে না এমন রায়ত নীলকুঠির সীমানা সরহদ্দের মধ্যে কেউ নেই। তিনি ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারেন। সে হাতজোড় করে বললে–মাপ করুন দেওয়ানজি, ক্ষ্যামা দ্যান। আপনি মা-বাপ, আপনি মারলি মারতে পারেন রাখলি রাখতে পারেন। মুই মুরুক্ষু মানুষ, আপনার সন্তানের মতো। মোর ওপর রাগ করবেন না। মরে যাবো। তা হলি–
–এখনই হয়েচে কি? তোমার উঠোনে গিয়ে নীলের দাগ মারবো। তোমার সায়ের বাবা যেন উদ্ধার করে তোমায় দেখি তোমার কতদূর
নবু গাজি এসে রাজারামের পা দুটো জড়িয়ে ধরলে।
রাজারাম রুক্ষ সুরে বললেন–না, আমার কাছে নয়। যাও তোমার সেই সায়েব বাবার কাছে।
নবু গাজি তবুও পা ছাড়ে না।
রাজারাম বললেন–কি?