আমিনের দিকে চেয়ে বললেন–খাসমহলের চিঠা তৈরি করেছেন?
–প্রায় সব হয়েচে। সামান্য কিছু বাকি।
–ওদের দিতি পারবেন? যাও, তোমরা আমিনমশাইয়ের কাছে যাও। এদের একটু দেখে দেবেন তো চিঠাগুলো। দূর থেকে এসেছে সব, আজই চলে যাবে।
প্রসন্ন চক্কত্তি বহুকাল এই কাজ করে এসেছে, গুড়ের কলসির কোন দিকে সার গুড় থাকে আর কোন দিকে ঝোলাগুড় থাকে তাকে সেটা দেখাতে হবে না। খাসমহলের চিঠা তৈরি থাকলেই কি আর সব গোলমাল মিটে যায়? সীমানা সরহদ্দ নিয়ে গোলমাল থাকে, অনেক কিছু গোলমাল থাকে, চিঠাতে নায়েবের সই করাতে হবে–অনেক কিছু হাঙ্গামা। এখন অবেলায় অতশত কাজ কি হয়ে উঠবে? বলা যায় না। চেষ্টা করে অবিশ্যি দেখা যাক।
নীলকুঠির দিনে এমন সব ব্যাপারে দুপয়সা আসতো। সে সব অনেক দিনের কথা হল। এখন যেন মনে হয় সব স্বপ্ন।
প্রজাদের তরফ থেকে একজন লোক এগিয়ে এসে বললে–করে দ্যান আমিনবাবু! আপনারে পান খেতি কিছু দেবো এখন
–কিছু কত?
–এক আনা করে মাথাপিছু দেবো এখন।
প্রসন্ন চক্কত্তি হাতের খেরো বাঁধা দপ্তর নামিয়ে রেখে বললে–তা হলি এখন হবে না। তোমার নায়েব মশাইকে গিয়ে বলতি পারো। চিঠে তৈরি হয়েচে বটে, এখনো সাবেক রেকর্ডের সঙ্গে মেলানো হয় নি, সই হয় নি। এখনো দশ পনেরো দিন কি মাসখানেক বিলম্ব। চিঠে তৈরি থাকলিই কাজ ফতে হয় না। অনেক কাঠখড় পোড়াতি হয়।
প্রজাদের মোড়ল বিনীতভাবে বললে–তা আপনি কত বলচো আমিনবাবু?
সেও অভিজ্ঞ লোক, আইন আদালত জমিদারি কাছারির গতিক এবং নাড়ি বিলক্ষণ জানে। কেন আমিনবাবু বেঁকে দাঁড়িয়েছে তাকে বোঝাতে হবে না।
প্রসন্ন চক্কত্তি অপ্রসন্ন মুখে বললে–না না, সে হবে না। তোমরা নায়েবের কাছেই যাও–আমার কাজ এখনো মেটে নি। দেরি হবে দশ-পনেরো দিন।
মোড়লমশাই হাত জোড় করে বললে–তা মোদের ওপর রাগ করবেন না আমিনমশাই। ছ পয়সা করে মাথাপিছু দেবানি–
–দু আনার এক কড়ি কম হলি পারবো না।
–গরিব মরে যাবে তা হলি–
–না। পারবো না।
বাধ্য হয়ে দশজন প্রজার পাঁচসিকে মোড়লমশাইকে ভালো ছেলের মতো সুড়সুড় করে এগিয়ে দিতে হল প্রসন্ন চক্কত্তির হাতে। পথে এসো বাপধন। চক্কত্তিকে আর কাজ শেখাতি হবে না ঘনশ্যাম চাকলাদারের। কি করে উপরি রোজগার করতে হয়, নীলকুঠির আমিনকে সে কৌশল শিখতে হবে পচা জমিদারি কাছারির আমলার কাছে? শাসন করতে এসেছেন! দেখেচিস শিপল্টন্ সাহেবকে?
বেলা তিন প্রহর। ঘনশ্যাম চাকলাদার আবার ডেকে পাঠালেন প্রসন্ন চক্কত্তিকে। ঘনশ্যাম নায়েব অত্যন্ত কর্মঠ, দুপুরে ঘুমের অভ্যেস নেই, গির্দে বালিশ বুকে দিয়ে জমার খাতা সই করবেন, পেশকার কাছে দাঁড়িয়ে পাতা উল্টে দিচ্চে। ফর্সিতে তামাক পুড়চে।
প্রসন্ন চক্কত্তির দিকে চেয়ে বললে–ওদের চিঠা দিয়ে দেলেন?
–আজ্ঞে হাঁ।
–ঘোড়া চড়তি পারেন?
আজ্ঞে।
–এখুনি একবার রাহাতুনপুর যেতি হচ্ছে আপনাকে। বিলাতালি সর্দার আর ওসমান গনির মামলায় আপনি প্রধান সাক্ষী হবেন। সরেজমিন দেখে আসুন। সেখানে নকুড় কাঁপালী কাছারির পক্ষে উপস্থিত আছে। সে আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে। ওসমান গনির ভিটের পেছনে যে শিমুলগাছটা আছে–সেটা কত চেন রাস্তা থেকে হবে মেপে আসবেন তো।
–চেন নিয়ে যাবো?
নিয়ে যান। আমার কানকাটা ঘোড়াটা নিয়ে যান, ছাড় তোক দেবেন না, বাঁ পায়ে ঠোকা মারবেন পেটে। খুব দৌড়বে।
এখন অবেলায় আবার চল রাহাতুনপুর! সে কি এখানে! ফিরতে কত রাত হবে কে জানে। নকুড় কাঁপালী সেখানে সব শেখাবে প্রসন্ন চক্কত্তিকে! হাসিও পায়। সে কি জানে জরিপের কাজের? আমিনের পিছু পিছু খোঁটা নিয়ে দৌড়োয়, বড়সাহেব যাকে বলতো পিনম্যান, সেই নকুড় কাঁপালী জরিপের খুঁটিনাটি তত্ত্ব বুঝিয়ে দেবে তাকে, যে পঁচিশ বছর এক কলমে কাজ চালিয়ে এল সায়েব-সুবোদের কড়া নজরে! শালুক চিনেচেন গোপাল ঠাকুর! নকুড় কাঁপালী!
ঘোড়া বেশ জোরেই চললো যশোর চুয়াডাঙ্গার পাকা সড়ক দিয়ে। আজকাল রেললাইন হয়ে গিয়েচে এদিকে। ক্রোশখানেক দূর দিয়ে রেলগাড়ি চলাচল করচে, ধোঁয়া ওড়ে, শব্দ হয়, বাঁশি বাজে। একদিন চড়তে হবে রেলের গাড়িতে। ভয় করে। এই বুড়ো বয়েসে আবার একটা বিপদ বাধবে ও সব নতুন কাণ্ডকারখানার মধ্যে গিয়ে? মানিক মুখুয্যে মুহুরী সেদিন বলছিল, চলুন আমিনমশাই, একদিন কালীগঞ্জে গঙ্গাস্নান করে আসা যাক রেলগাড়িতে চড়ে। ছআনা নাকি ভাড়া রাণাঘাট পর্যন্ত। সাহস হয় না।
বড় বড় শিউলি গাছের ছায়া পথের দুধারে। শ্যামলতা ফুলের সুগন্ধ যেন কোনো বিস্মৃত অতীত দিনের কার চুলের গন্ধের মতো মনে হয়। কিছুই আজ আর মনে নেই। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। হাতও খালি। সামনে কতদিন বেঁচে থাকতে হবে, কি করে চলবে, অকর্মণ্য হয়ে পড়ে থাকলে কে দেবে খেতে? কেউ নেই সংসারে। বুড়ো বয়েসে যদি চেন টেনে জমি মাপামাপির খাটাখাটুনি না করতে পারে মাঠে মাঠে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, তবে কে দুমুঠো ভাত দেবে? কেউ নেই। সামনে অন্ধকার। যেমন অন্ধকার ওই বাঁশঝাড়ের তলায় তলায় জমে আসবে আর একটু পরে।
রাহাতুনপুর পৌঁছে গেল ঘোড়া তিন ঘণ্টার মধ্যে। প্রায় এগারো ক্রোশ পথ। এখানে সকলেই ওকে চেনে। নীলকুঠির আমলে কতবার এখানে সে আর কারকুন আসতো নীলের দাগ মারতি। এখানে একবার দাঙ্গা হয় দেওয়ান রাজারাম রায়ের আমলে। খুব গোলমাল হয়, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন প্রজাদের দরখাস্ত পেয়ে।