–যাই, কি বলেন?
–এখুনি যাও। আর দ্রিং কোরো না।
রতিলাল চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল সে মাছের খাড়ই হাতে বার হয়ে গেল কাছারির হাতা থেকে। প্রসন্ন চক্কত্তির মন শান্ত হয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে। রোদে বসে তেল মেখে এইবার নেয়ে নেওয়া যাক। কাঁঠালগাছতলায় রোদে পিঁড়ি পেতে সে রাঙা গামছা পরে তেল মাখতে বসলো। স্নান সেরে এসে রান্না করতে হবে।
কত বেগুন এ সময়ে দিয়ে যেতো প্রজারা। বেগুন, ঝিঙে, নতুন মুলো। শুধু তাকে নয়, সব আমলাই পেতে। নরহরি পেশকার তাকে সব তার পাওনা জিনিস দিয়ে বলতো,–প্রসন্নদা, আপনি হোলেন। ব্রাহ্মণ মানুষ। রান্নাড়া আপনাদের বংশগত জিনিস। আমার দুটো ভাত আপনি বেঁধে রাখবেন দাদা।
সুবিধে ছিল। একটা লোকের জন্যে রাঁধতেও যা, দুজন লোকের রাঁধতেও প্রায় সেই খরচ, টাকা তিনচার পড়তো দুজনের মাসিক খরচ। নরহরি চাল ডাল সবি যোগাতো। চমৎকার খাঁটি দুধটুকু পাওয়া যেতো, এ ও দিয়ে যেতো, পয়সা দিয়ে বড় একটা হয় নি জিনিস কিনতে। আহা, গয়ার কথা মনে পড়ে।
গয়া!…গয়ামেম!
না। তার কথা ভাবলেই কেন তার মন ওরকম খারাপ হয়ে যায়? গয়ামেম ওর দিকে ভালো চোখে তাকিয়েছিল। দুঃখের তো পারাপার নেই জীবনে, ছেলেবেলা থেকেই দুঃখের পেছনে ধোঁয়া দিতে দিতে জীবনটা কেটে গেল। কেউ কখনো হেসে কথা বলে নি, মিষ্টি গলায় কেউ কখনো ডাকে নি। গয়া কেবল সেই সাধটা পূর্ণ করেছিল জীবনের। অমন সুঠাম সুন্দরী, একরাশ কলো চুল। বড়সাহেবের আদরিণী আয়া গয়ামেম তার মতো লোকের দিকে যে কেন ভালো চোখে চাইবে এর কোনো হেতু খুঁজে মেলে? তবু সে চেয়েছিল।
কেমন মিষ্টি গলায় ডাকতো–খুড়োমশাই, অ খুড়োমশাই
বয়েসে সে বুড়ো ওর তুলনায়। তবু তো গয়া তাকে তাচ্ছিল্য করে। নি। কেন করে নি? কেন ছলছুতো খুঁজে তার সঙ্গে গয়া হাসিমশকরা করতো, কেন তাকে প্রশ্রয় দিত? কেন অমন ভাবে সুন্দর হাসি হাসতো তার দিকে চেয়ে? কেন তাকে নাচিয়ে ও অমন আনন্দ পেতো? আজকাল গয়া কেমন আছে? কতকাল দেখা হয় নি। বড় কষ্টে পড়েছে হয়তো, কে জানে? কত দিন রাত্রে মন-কেমন করে ওর জন্যে। অনেক কাল দেখা হয় নি।
–ও আমিনমশাই, মাছ প্যালাম না–
রতিলালের মাছের খাড়ই হাতে প্রবেশ। সর্বশরীর জ্বলে গেল প্রসন্ন চক্কত্তির। আ মোলো যা, আমি তোমার এয়ার, দরের লোক? ব্যাটা জল-টানা বাসন-মাজা চাকর, সমানে সমানে আজ খোশগল্প করতে এয়েচে একগাল দাঁত বার করে তার সঙ্গে। চেনে না সে প্রসন্ন। আমিনকে? দিন চলে গিয়েচে, আজ বিষহীন ঢোঁড়া সাপ প্রসন্ন চক্কত্তি এ কথার উত্তর কি করে দেবে? সে মোল্লাহাটির নীলকুঠি নেই, সে বড়সাহেব শিপটও নেই, সে রাজারাম দেওয়ানও নেই।
নীলকুঠির আমলে শাসন বলে জিনিস ছিল, লোকে ভয়ে কাঁপতে লাল মুখ দেখলে, এসব দিশী জমিদারের কাছারিতে ভূতের কেত্তন। কেউ কাকে মানে? মারো দুশো ঝাঁটা!
বিরক্তি সহকারে আমিন রতিলালের কথার উত্তরে বললে–ও। নীরসকণ্ঠেই বলে।
রতিলাল বললে–তেল মাখচেন?
–হুঁ।
–নাইতি যাবেন?
–হুঁ।
–কি রান্না করবেন ভাবছেন?
–কি এমন আর? ডাল আর উচ্ছে চচ্চড়ি। ঘোল আছে।
–ঘোল না থাকে দেবানি। সনকা গোয়ালিনী আধ কলসি মাঠাওয়ালা ঘোল দিয়ে গিয়েচে। নেবেন?
–না, আমার আছে।
বলেই প্রসন্ন চক্কত্তি রতিলালকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি গামছা কাঁধে নিয়ে ইছামতীতে নাইতে চলে গেল। কি বিপদই হয়েচে। ওর সঙ্গে এখন বকবক করে বসে বসে। খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই। ব্যাটা বেয়াদবের নাজির কোথাকার!
রান্না করতে করতেও ভাবে, কতদিন ধরে সে আজ একা রান্না করচে। বিশ বছর?
না, তারও বেশি। স্ত্রী সরস্বতী সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন বহুদিন। তারপর থেকেই হাঁড়িবেড়ি হাতে উঠেছে। আর নামলো কই? রান্না করলে যা রোজই বেঁধে থাকে প্রসন্ন, তার অতি প্রিয় খাদ্য। খুব বেশি কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, উচ্ছে ভাজা। ব্যস! হয়ে। গেল। কে বেশি ঝঞ্ঝাট করে। আর অবিশ্যি ঘোল আছে।
–ডাল রান্না করলেন নাকি?
জলের ঘটি উঁচু করে আলগোছে খেতে খেতে প্রায় বিষম খেতে হয়েছিল আর কি! কোথাকার ভূত এ ব্যাটা, দিখচিস একটা মানুষ। তেতপ্পরে দুটো খেতে বসেচে। এক ঘটি জল খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় তোমার কথা না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, না তোমার বাপের জমিদারি লাটে উঠেছিল, বদমাইশ পাজি! বিরক্তির সুরে জবাব দেয় প্রসন্ন চক্কত্তি। কেন?
–কিসের ডাল?
–মাসকলাইয়ের।
–আমারে একটু দেবেন? বাটি আনবো?
–নেই আর। এক কাঁসি বেঁধেছিলাম, খেয়ে ফেললাম।
–আমি যে ঘোল এনিচি আপনার জন্যি–
–আমার ঘোল আছে। কিনিছিলাম।
–এ খুব ভালো ঘোল। সনকা গোয়ালিনীর নামডাকী ঘোল। বিষ্ট ঘোষের বিধবা দিদি। চেনেন? মাঠওয়ালা ঘোল ও ছাড়া কেউ কত্তি জানেও না। খেয়ে দ্যাখেন।
নামটা বেশ। মরুক গে। ঘোল খারাপ করে নি। বেশ জিনিসটা। এ গাঁয়ে থাকে সনকা গোয়ালিনী? বয়েস কত?
এক কল্কে তামাক সেজে খেয়ে প্রসন্ন একটু শুয়ে নিলে ময়লা বিছানায়। সবে সে চোখ একটু বুজেছে, এমন সময় পাইক এসে ডাক দিলে–নায়েমশায় ডাকচেন আপনারে–
ধড়মড় করে উঠে প্রসন্ন চক্কত্তি কাছারিঘরে ঢুকলো। অনেক প্রজার ভিড় হয়েচে। আমিনের জরিপি চিঠার নকল নিতে এসেচে আট-দশটি লোক। নায়েব ঘনশ্যাম চাকলাদার রাশভারী লোক, পাকা গোঁপ, মুখ গম্ভীর, মোটা ধুতি পরনে, কোঁচার মুড়ো গায়ে দিয়ে ফরাশে বসেছিলেন আধময়লা একটা গির্দে হেলান দিয়ে। রূপো-বাঁধানো ফর্সিতে তামাক দিয়ে গেল রতিলাল নাপিত।