খোকা এদিকে পাঠশালার পড়া শেষ করলে। ভবানী একদিন তিলুর সঙ্গে পরামর্শ করলেন ওকে ছাত্রবৃত্তি পড়িয়ে মোক্তারি পড়াবেন না টোলে সংস্কৃত পড়তে দেবেন। মোক্তারি পড়লে সতীশ মোক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার।
তিলু বললে–নিলুকে ডাকো।
নিলুর আর সে স্বভাব নেই। এখন সে পাকা গিন্নি। সংসারের সব কাজ নিখুঁতভাবে খুঁটিয়ে করতে ওর জুড়ি নেই। সে এসে বললে– টুলুকে জিজ্ঞেস করো না? আহা, কি সব বুদ্ধি!
টুলুর ভালো নাম রাজ্যেশ্বর। সে গম্ভীর স্বভাবের ছেলে, চেহারা খুব সুন্দর, যেমন রূপ তেমনি বুদ্ধি। বাবাকে বড় ভালবাসে। বিশেষ পিতৃভক্ত। সে এসে হেসে বললে–বাবা বলো না? আমি কি জানি? আর ছোট মা তো কিছু জানেই না। কলের গাড়িতে উঠে সেদিন। দেখলে না? পান সাজতে বসলো। রানাঘাট থেকে কলের গাড়ি ছাড়লো। তো টুক করে এলো আড়ংঘাটা। আর ছোট মার কি কষ্ট! বললে, দুটো পান সাজতি সাজতি গাড়ি এসে গেল তিনকোশ রাস্তা! হি-হি
নিলু বললে–তা কি জানি বাবা, আমরা বুড়োসুড়ো মানুষ। চাকদাতে আগে আগে গঙ্গাস্নান করতি য্যাম পানের বাটা নিয়ে পান সাজতি সাজতি। অমন হাসতি হবে না তোমারে
–আমি অন্যায় কি বল্লাম? তুমি কি জানো পড়াশুনোর? মা তবুও সংস্কৃত পড়েছে কিছু কিছু। তুমি একেবারে মুখু।
–তুই শেখাস আমায় খোকা।
–আমি শেখাবো? এই বয়সে উনি ক, খ, আ, আ–ভারি মজা!
–তোরে ছানার পায়েস খাওয়াবো ওবেলা।
–ঠিক?
–ঠিক।
-তা হলি তুমি খুব ভালো। মোটেই মুখু না।
ভবানী বললে–আঃ, এই টুলু! ওসব এখন রাখো। আসল কথার জবাব দে।
–তুমি বলো বাবা।
–কি ইচ্ছে তোমার?
এই সময় নিলু আবার বললে–ওকে মোক্তারি-টোক্তারি করতি দেবেন না। ইংরিজি পড়ান ওকে। কলকেতায় পাঠতি হবে। ওই শম্ভু দ্যাখো কেমন করেচে কলকেতায় চাকরি করে। তার চেয়ে কম বুদ্ধিমান কি টুলু?
ভবানী বাঁড়ুয্যে বললেন–কি বলো খোকা?
–ছোট মা ঠিক বলেচে। তাই হোক বাবা। মা কি বলো? ছোট মা ঠিক বলে নি?
নিলু অভিমানের সুরে বললে–কেন মুখু যে? আমি আবার কি জানি?
টুলু বললে–না ছোট মা। হাসি না। তোমার কথা আমার মনে লেগেচে। ইংরিজি পড়তি আমারও ইচ্ছে–তাই তুমি ঠিক করো বাবা। ইংরিজি শেখাবে কে?
নিলু বললে–তা আমি কি করে বলবো? সে তোমরা ঠিক কর।
–তাই তো, কথাডা ঠিক বলেচে খোকা। ইংরিজি পড়বে কার কাছে খোকা। গ্রামে কেউ ইংরিজি জানে না, কেবল ইংরিজিনবিশ শম্ভু রায়। সে বহুকাল থেকে আমুটি কোম্পানির হৌসে কাজ করে, সায়েব-সুবোদের সঙ্গে ইংরিজি বলে। গাঁয়ে এজন্যে তার খুব সম্মান– মাঝে মাঝে অকারণে গাঁয়ের লোকদের সামনে ইংরিজি বলে বাহাদুরি নেবার জন্যে।
তিলু হেসে বললে–এই খোকা, তোর শম্ভুদাদা কেমন ইংরিজি বলে রে?
–ইট সেইষ্ট মাট ফুট–ইট সুনটু-ফুট-ফিট—
ভবানী বললে–বা রে! কখন শিখলি এত?
টুলু বললে–শুনে শিখিচি। বলে তাই শুনি কিনা। যা বলে, সেরকম বলি।
ভবানী বললেন–সত্যি, ঠিক ইংরিজি শিখেচে দ্যাখো। কেমন। বলচে।
নিলু বললে–সত্যি, ঠিক বলচে তো!
তিনজনেই খুব খুশি হল খোকার বুদ্ধি দেখে। খোকা উৎসাহ পেয়ে বললে–আমি আরো জানি, বলবো বাবা? সিট এ হি-সিট-ফুট এপট-আই-মাই–ও বাবা এ দুটো কথা খুব বলে আই আর মাই– সত্যি বলচি বাবা
নিলু অবাক হয়ে ভাবলে–কি আশ্চর্য বুদ্ধিমান তাদের খোকা।
.
প্রসন্ন চক্রবর্তী নীলকুঠির চাকরি যাওয়ার পরে দুবছর বড় কষ্ট পেয়েছে। আমিনের চাকরি জোটানো বড় কষ্ট। বসে বসে সংসার চলে কোথা থেকে। অনেক সন্ধানের পর বর্তমান চাকরিটা জুটে গিয়েচে বটে কিন্তু নীলকুঠির মতো অমন সুখ আর কোথায় পাওয়া যাবে চাকরির? তেমন ঘরবাড়ি, তেমন পসার-প্রতিপত্তি দিশী জমিদারের কাছারিতে হবে না, হতে পারে না। চার বছর তবু কাটলো এদের এখানকার চাকরিতে। এটা পাল এস্টেটের বাহাদুরপুরের কাছারি। সকালে নায়েব ঘনশ্যাম চাকলাদার পালকি করে বেরিয়ে গেলেন চিতলমারির খাসখামারের তদারক করতে। প্রসন্ন আমিন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। এরা নতুন মনিব, অনেক বুঝে চলতে হয় এদের কাছে, আর সে রাজারাম দেওয়ানও নেই, সে বড়সাহেবও নেই। নায়েবের চাকর রতিলাল নাপিত ঘরে ঢুকে বললেও আমিনবাবু, কি করচেন?
–এই বসে আছি। কেন?
–নায়েববাবুর হাঁসটা এদিকি এয়েলো? দেখেছেন?
–দেখি নি।
–তামাক খাবেন?
–সাজ দিকি এট্টু।
রতিলাল তামাক সেজে নিয়ে এল। সে নিজে নিয়ে না এলে নায়েবের চাকরকে হুকুম করার মতো সাহস নেই প্রসন্ন চক্রবর্তীর।
রতিলাল বললে–আমিনবাবু, সকালে তো মাছ দিয়ে গেল না গিরে জেলে?
–দেবার কথা ছিল? গিরে কাল বিকেলে হাটে মাছ বেচছিল দেখিচি। আড় মাছ।
–রোজ তো দ্যায়, আজ এল না কেন কি জানি? নায়েবমশায় মাছ না হলি ভাত খেতি পারেন না মোটে। দেখি আর খানিক। যদি না আনে, জেলেপাড়া পানে দৌড়তি হবে মাছের জন্যি।
রতিলালের ভ্যাজ-ভ্যাজ ভালো লাগছিল না প্রসন্ন চক্কত্তির। তার মন ভালো না আজ, তা ছাড়া নায়েবের চাকরের সঙ্গে বেশিক্ষণ গল্প। করবার প্রবৃত্তি হয় না। আজই না হয় অবস্থার বৈগুণ্যে প্রসন্ন চক্কত্তি এখানে এসে পড়েচে বেঘোরে, কিন্তু কি সম্মানে ও রোবদাবে কাটিয়ে এসেচে এতকাল মোল্লাহাটির কুঠিতে, তা তো ভুলতে পারছে না সে।
আপদ বিদায় করার উদ্দেশ্যে প্রসন্ন আমিন তাড়াতাড়ি বললে–তা মাছ যদি নিতি হয়, এই বেলা যাও, বেশি বেলা হয়ে গেলি মাছ সব নিয়ে যাবে এখন সোনাখালির বাজারে।