–বোসো না। যা দিই খাও না।
স্বামীর পাতে অনেকদিন পরে সুখাদ্য পরিবেশন করে দিতে পেরে স্বর্ণ বড় খুশি হল। দরিদ্রের ঘরণী সে, শ্বশুর বেঁচে থাকতেও দেখেচে মোটা চালভাজা ছাড়া কোনো জলপান জুটতো না তার। ইদানীং দাঁত ছিল না বলে স্বর্ণ শ্বশুরকে চালভাজা গুঁড়ো করে দিত।
যতীন বললে–বাঃ, এ সব পেলে কোথায়?
–কাউকে বোলো না। তুলসীদের বাড়ি। তুলসী নিজে এসে হাত জোড় করে সেদিন নেমন্তন্ন করে গেল। বড় ভালো মেয়ে। ট্যাকার অংখার নেই এতটুকু।
–কে কে গিয়েছিলে?
–নন্দরাণী আর সুবাসী। ছেলেমেয়েরা। তুলসী দিদি কি খুশি! সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ালে। আসবার সময় জোর করে এক মালসা লুচি চিনি ছাঁদা দিলে।
–ভালো করেচ। খেতে পায় না কিছু, কেডা দিচ্ছে ভালো খেতি একটু?
–যদি টের পায় গাঁয়ে?
–ফাঁসি দেবে না শূলে দেবে? বেশ করেচ। নেমন্তন্ন করেছিল, গিয়েচ? বিনি নেমন্তন্নে তো যাও নি।
–ঠাকুরুজামাই ছিলেন। তিলুদিদি নিলুদিদি ছিল।
–ওদের কেউ কিছু বলতি সাহস করবে না। আমরা গরিব, আমাদের ওপর যত সব দোষ এসে পড়বে। তা হোক। পেট ভরে লুচি খেয়েছ? ছেলেমেয়েদের খাইয়েচ? ওদের জন্যে রেখে দ্যাও, সকালে উঠে খাবে এখন। কাউকে গল্প করে বেড়িও না যেখানে সেখানে। মিটে গেল। তুমি বেশ করে খেয়েচ কিনা বলো।
-না খেলি তুলসীদিদি শোনে? হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধ বলবে, খ্যালেন না, পেট ভরলো না—
.
খোকার জন্মতিথিতে রামহরি চক্রবর্তী এলেন ভবানীর বাড়িতে। সঙ্গে তাঁর দুটি ছেলে। সঙ্গে নিয়ে এলেন খোকনের জন্যে স্ত্রীর প্রদত্ত সরু ধানের খই ও ক্ষীরের ছাঁচ। ভবানীর বাড়ির পশ্চিম পোতার ঘরের দাওয়ায় মাদুর বিছানো রয়েচে অতিথিদের জন্যে। বেশি লোক নয়, রামকানাই কবিরাজ, ফণি চক্কত্তি, শ্যাম মুখুয্যে, নীলমণি সমাদ্দার আর যতীন। মেয়েদের মধ্যে নিস্তারিণী, যতীনের স্ত্রী স্বর্ণ আর নীলমণি সমাদ্দারের পুত্রবধূ সুবাসী।
ফণি চক্কত্তি বললেন–আরে রামহরি যে! ভালো আছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ! প্রণাম দাদা। আপনি কেমন?
–আর কেমন! এখন বয়েস হয়েচে, গেলেই হোলো। বুড়োদের মধ্যি আমি আর নীলমণি দাদা এখনো ভালোই আছি, এবং টিকে আছি। আর তো একে একে সব চলে গেল।
–দাদার বয়েস হোলো কত?
–এই ঊনসত্তর যাচ্চে।
-বলেন কি? দেখলি তো মনে হয় না। এখনো দাঁত পড়ে নি।
–এখনো আধসের চালির ভাত খাবো। আধ কাঠা চিড়ের ফলার খাবো। আধখানা পাকা কাঁটাল এক জায়গায় বসে খাবো। দুবেলা আড়াইসের দুধ খাই এখনো, খেয়ে হজম করি।
–সেই খাওয়ার ভোগ আছে বলে এখনো এমনডা শরীল রয়েছে। নইলি–
–আচ্ছা, একটা কথা বলি রামহরি। সেদিন কি কাণ্ডটা করলে তোমরা! আংরালি আর গদাধরপুরির বাঁওনদের কি একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই? নেমন্তন্ন করেছে বলেই পাতা পাড়তি হবে যেয়ে শূদুর বাড়ি! ছিঃ ছিঃ, ব্রাহ্মণ তো? গলায় পৈতে রয়েচে তো? নাই বা হোলো কুলীন। কুলীন সকলে হয় না, কিন্তু মান অপমান জ্ঞান সবার থাকা দরকার।
কথাগুলোতে নীলমণি সমাদ্দার বড় অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী ও পুত্রবধূও সেদিন যে বেশি রাত্রে লুকিয়ে ওদের বাড়ি গিয়ে ভোজ খেয়ে এসেছে এ কথা প্রকাশ না হয়ে পড়ে। পড়লেই বড় মুশকিল। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় ঠিক সেই সময় ভবানী বাঁড়ুয্যে এসে ওদের খাবার জন্যে আহ্বান করলেন। কথা চাপা পড়ে গেল।
শ্ৰোত্রিয় ব্রাহ্মণ রামহরি চক্রবর্তীর সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ফণি চক্কত্তি ও এরা খাবেন না। অন্য জায়গায় পিঁড়ি পেতে বসিয়ে খাওয়ানো হল এবং শুধু তাই নয়, খোকাকে তার জন্মদিনের পায়েস খাওয়ানোর ভার পড়লো তাঁর ওপর। রামহরি চক্রবর্তীর পাশেই খোকার সিঁড়ি পাতা। ঘোমটা দিয়ে তিলু ওদের দুজনকে বাতাস করতে লাগল বসে।
রামহরি বললেন–তোমার নাম কি দাদু?
খোকা লাজুক সুরে বললে–শ্রীরাজ্যেশ্বর বন্দোপাধ্যায়।
–কি পড়?
এবার উৎসাহ পেয়ে খোকা বললে–হরু গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়ি। কলকাতায় থাকে শম্ভদাদা, তার কাছে ইংরেজি পড়তি চেয়েচি, সে শেখাবে বলেচে।
–বাঃ বাঃ, এইটুকু ছেলে নাকি ইঞ্জিরি পড়বে! তবে তো তুমি দেশের হাকিম হবা। বেশ দাদু, বেশ। হাকিম হওয়ার মতো চেহারাখানা বটে।
–মা বলচে, আপনি আর কিছু নেবেন না?
–না, না, যথেষ্ট হয়েচে। তিনবার পায়েস নিইচি, আবার কি? বেঁচে থাকো দাদু।
বামুন ভোজনের দালাল রামহরি চক্রবর্তীকে এমন সম্মান কেউ দেয় নি কুলীন ব্রাহ্মণের বাড়িতে। বিদায় নিয়ে যাবার সময়ে রামহরি তিলুকে প্রণাম করে বললেন–চলি মা, চেরা কাল মনে থাকবে, আজ যা করলে মা আমার। এ যত্ন কখনো ভোলবো না। আজ বোঝলাম আপনার এ দিগরের রামা শামার মতো লোক নন। দুহাত দুপা থাকলি মানুষ হয় না মা। গলায় পৈতে ঝোলালি কুলীন ব্রাহ্মণ হয় না—
.
কত কি পরিবর্তন হয়ে গেল গ্রামে। রেল খুললো চাকদা থেকে চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত একদিন তিলু ও নিলু স্বামীর সঙ্গে আড়ংঘাটায় ঠাকুর দেখতে গেল জ্যৈষ্ঠ মাসে। ওরা গোরুর গাড়ি করে চাকদা পর্যন্ত এসে গঙ্গাস্নান করে সেখানে বেঁধেবেড়ে খেলে। সঙ্গে খোকা ছিল, তার খুব উৎসাহ রেলগাড়ি দেখবার। শেষকালে রেলগাড়ি এসে গেল। ওরা। সবাই সেই পরমাশ্চর্য জিনিসটিতে চড়ে গেল আড়ংঘাটা। ফিরে এসে বছরখানেক ধরে তার গল্প আর ফুরোয় না ওদের কারো মুখে।