–খাও বাবা ভালো করে। আর নিবি?
বালক ঘাড় নেড়ে বললে–হুঁ।
ভবানীর ইঙ্গিতে তিলু খানকতক গরম লুচি খোকার পাতে দিয়ে গেল। ভবানীকে তিলু ও নিলুই খাবার পরিবেশন করছিল। এমন সময় নালু পাল সেখানে রামহরি চক্রবর্তীকে নিয়ে ঢুকে ভোজনরত ভবানীর সামনে অথচ হাতদশেক দূরে জোড়হাতে দাঁড়ালো।
-কি?
–ইনি এসেছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করতি।
রামহরি চক্রবর্তী প্রণাম করে বললেন–দেখে বোঝলাম আজ কার মুখ দেখেই উঠিচি।
ভবানী হেসে বললেন–খুব খারাপ লোকের মুখ তো?
–অমন কথাই বলবেন না জামাইবাবু। আমি যদি আগে জানতাম আপনি আর আমার মা এখেনে এসে খাবেন, তবে পালমশায়কে বলতাম আর অন্য কোনো বামুন এল না এল, আপনার বয়েই গেল। এমন নিধি পেয়ে আবার বামুন খাওয়ানোর জন্যি পয়সা খরচ? কই, মা কোথায়? ছেলে একবার না দেখে যাবে না যে, বার হও মা আমার সামনে।
তিলু আধঘোমটা দিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতেই রামহরি হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন–যেমন শিব, তেমনি শিবানী। দিন বড় ভালো গেল আজ পালমশায়। মা, ছেলেডারে মনে রেখো।
ভবানীকে তিলু ফিসফিস্ করে বললে–পুন্নিমের দিন আমাদের বাড়িতি দেবেন পায়ের ধুলো? খোকার জন্মদিনের পরবন্ন হবে। এসে খাবেন।
এই রকমই বিধি। পরপুরুষের সঙ্গে কথা কওয়ার নিয়ম নেই, এমন কি সামনেও কথা বলবার নিয়ম নেই। একজন মধ্যস্থ করে কথা বলা যায় কিন্তু সরাসরি নয়। ভবানী বুঝিয়ে বলবার আগেই রামহরি চক্রবর্তী বললেন–আমি তাই করবো মা। পরবন্ন খেয়ে আসবো। এ আমার ভাগ্য। এ ভাগ্যির কথা বাড়ি গিয়ে তোমার বৌমার কাছে গল্প করতি হবে।
–তাঁকেও আনবেন না?
–না মা, সে সেকেলে। আপনাদের মতো আজকালের উপযুক্ত নয়। সে পুরুষমানুষের সামনে বেরুবেই না। আমিই এসে আমার খোকন ভাইয়ের সঙ্গে পরবন্ন ভাগ করে খেয়ে যাবো আর আপনাদের গুণ গেয়ে যাবো।
নীলমণি সমাদ্দারের স্ত্রী আন্নাকালী তাঁর পুত্রবধূ সুবাসীকে বললেন– হ্যাঁ বৌমা, কিছু শুনলে নাকি গাঁয়ে? ও দিকির কথা?
পুত্রবধূ জানে শাশুড়ি ঠাকরুন বলেছেন, বড়লোকের বাড়ির দুর্গোৎসবে জাঁকালী নেমন্তন্নটা ফকে যাবে, না টিকে থাকবে! ওদের অবস্থা হীন বলে এবং কখনো কিছু খেতে পায় না বলে ক্রিয়াকর্মের নিমন্ত্রণের আমন্ত্রণের দিকে ওদের নজরটা একটু প্রখর।
সুবাসী ভালোমানুষ বৌ। লাজুক আগে ছিল, এখন ক্রমগত পরের বাড়িতে ধার চাইতে গিয়ে গিয়ে লজ্জা হারিয়ে ফেলেচে। খবরাখবর সেও কিছু সংগ্রহ করেছে। যা শুনেচে তাই বললে। গাঁয়ের ব্রাহ্মণেরা কেউ খাবে না নালু পালের বাড়ি।
আন্নাকালী বললে–যাও দিকি একবার স্বর্ণদের বাড়ি।
–তুমি যাবে মা?
-আমি ডাল বাটি। ডাল কটা ভিজতি দিয়েলাম, না বাটলি নষ্ট হয়ে যাবে, বচ্ছরের পোড়ানি তো উঠলোই না। শোন তোরে বলি। বৌমা
–কি মা?
আন্নাকালী এদিক ওদিক চেয়ে গলার সুর নিচু করে বললেন– স্বর্ণকে বলে আয়, আর যদি কেউ না যায়, আমরা দুঘর লুকিয়ে যাবো একটু বেশি রাত্তিরি। তুই কি বলিস?
–ফণি জ্যাঠামশাই কি ওঁর বৌ দেখতি পেলি বাঁচবে?
–রাত হলি যাবো। কেডা টের পাচ্ছে!
–এ গাঁয়ে গাছপালার কান আছে।
–তুই জেনে আয় তো।
সুবাসী গেল যতীনের বৌ স্বর্ণের কাছে। এরাও গাঁয়ের মধ্যে বড় গরিব। একরাশ থোড় কুটছে বসে বসে স্বর্ণ। পাশে দুটো ডেঙো ডাঁটার পাকা ঝাড়। সুবাসী বললে–কি রান্না করচো স্বর্ণদিদি?
–এসো সুবাসী। উনি বাড়ি নেই, তাই ভাবলাম মেয়েমানুষির রান্না আর কি করবো, ডাঁটাশাকের চচ্চড়ি করি আর কলায়ের ডাল রাঁধি।
–সত্যি তো।
–বোস্ সুবাসী।
–বসবো না দিদি। শাশুড়ি বলে পাঠালে, তোমরা কি তুলসীদিদিদের বাড়ি নেমন্তন্নে যাবা?
-ননদ তো বলছিল, যাবা নাকি বৌদিদি? আমি বললাম, গাঁয়ের কোনো বামুন যাবে না, সেখানে কি করে যাই বল। তোরা যাবি?
–তোমরা যদি যাও, তবে যাই।
–একবার নন্দরাণীকে ডেকে নিয়ে আয় দিকি।
যতীনের বোন নন্দরাণীকে ফেলে ওর স্বামী আজ অনেকদিন কোথায় চলে গিয়েচে। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলে। যতীনের বাবা রূপলাল মুখুয্যে কুলীন পাত্রেই মেয়ে দিয়েচিলেন অনেক যোগাড়যন্ত্র করে। কিন্তু সে পাত্রটির আরো অনেক বিয়ে ছিল, একবার এসে কিছু প্রণামী আদায় করে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে যেতো। নন্দরাণীর ঘাড়ে দুতিনটি কুলীন কন্যার বোঝা চাপিয়ে আজ বছর চার-পাঁচ একেবারে গা-ঢাকা দিয়েচে। কুলীনের ঘরে এই রকমই নাকি হয়।
নন্দরাণী পিঁড়ি পেতে বসে রোদে চুল শুকুচ্ছিল। সুবাসীর ডাকে উঠে এল। তিনজনে মিলে পরামর্শ করতে বসলো।
নন্দরাণী বললে–বেশি রাতে গেলি কেডা দ্যাখছে?
স্বর্ণ বললে–তবে তাই চলো। তুলসীকে চটিয়ে লাভ নেই। আপদে বিপদে তুলসী বরং দেখে, আর কেউ দেখবে? একঘরে করার বেলা সবাই আছে।
অনেক রাত্রে ওরা লুকিয়ে গেল তুলসীদের বাড়ি। তুলসী যত্ন করে খাওয়ালে ওদের সঙ্গে এক এক পুঁটুলি ছাঁদা বেঁধে দিলে। যতীন সে রাত্রেই বাড়ি এল। স্বর্ণ এসে দেখলে, স্বামী শেকল খুলে ঘরে আলো জ্বেলে বসে আছে। স্ত্রীকে দেখে বললে–কোথায় গিইছিলে? হাতে ও কি? গাইঘাটা থেকে দুকাঠা সোনামুগ চেয়ে আনলাম এক প্রজা-বাড়ি থেকে। ছেলেপিলে খাবে আনন্দ করে। তোমার হাতে ও কি গা?
–সে খোঁজে দরকার নেই। খাবে তো?
–খিদে পেয়েছে খুব। ভাত আছে?