–ভাত কেউ খাবেন না। আমি গাওয়া ঘি আনিয়েচি, লুচি ভেজে খাওয়াবো। আপনি একটু জামাইঠাকুরকে বলুন দিদি। আপনাদের বাড়িতি তো হয়ই, আমার নিজের বাড়িতি পাতা পেড়ে বেরাহ্মণরা খাবেন, আপনাদের পায়ের ধুলো পড়ুক আমার বাড়িতি, এ সাধ আমার হয় না? লুচিচিনির ফলারে অমত কেন করবেন ঠাকুরমশাইরা?
ভবানী বাঁড়ুয্যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিলুর মুখে সব শুনে তিনি বললেন আমার সাধ্য না। এ কুলীনের গাঁয়ে ও সব হবে না। তবে আংরালি গদাধরপুর আর নসরাপুরের ব্রাহ্মণদের অনেকে আসবে। সেখানে শ্ৰোত্রিয় ব্রাহ্মণ বেশি। নালু পালকে তিনি সেইরকম পরামর্শ দিলেন।
নালু পাল হাতজোড় করে বললে–আপনি থাকবেন কি না আমায়। বলুন জামাইঠাকুর!
থাকবো।
–কথা দেচ্চেন?
–নইলে তোমার এখানে আসতাম?
–ব্যাস। কোনো ব্রাহ্মণ-দেবতাকে আমার দরকার নেই, আপনি আর দিদিরা থাকলি ষোলকলা পুন্ন্য হোলা আমার।
–তা হয় না নালু। তুমি ওগাঁয়ের ব্রাহ্মণদের কাছে লোক পাঠাও, নয়তো নিজে যাও। তাদের মত নাও।
আংরালি থেকে এলেন রামহরি চক্রবর্তী বলে একজন ব্যক্তি আর নসরাপুর থেকে এলেন সাতকড়ি ঘোষাল। তাঁরা সমাজের দালাল। তাঁরা সন্ধির শর্ত করতে এলেন নালু পালের সঙ্গে।
রামহরি চক্রবর্তীর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। বেঁটে কালো, একমুখ দাড়ি গোঁফ। মাথার টিকিতে একটি মাদুলি বাঁধা। বাহুতে রামকবচ। বিদ্যা ঐ গ্রামের সেকালের হরু গুরুমশায়ের পাঠশালার নামতার ডাক পর্যন্ত। তিনি ছিলেন ঘোষার সর্দার। অর্থাৎ নামতা ঘোষবার বা চেঁচিয়ে ডাক পড়াবার তিনিই ছিলেন সর্দার।
রামহরি সব শুনে বললেন–এই সাতকড়ি ভায়াও আছে। পালমশায়, আপনি ধনী লোক, আমরা সব জানি। কিন্তু আপনার বাড়িতে পাতা পাড়িয়ে ব্রাহ্মণ খাওয়ানো, এ কখনো এ দেশে হয় নি। তবে তা আমরা দুজনে করিয়ে দেবো। কি বল হে সাতকড়ি?
সাতকড়ি ঘোষাল অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সের লোক, তবে বেশ ফর্সা আর একটু দীর্ঘাকৃতি। কৃশকায়ও বটে। মুখ দেখেই মনে হয় নিরীহ, ভালোমানুষ, হয়তো কিছু অভাবগ্রস্থ ব্যক্তি, সাংসারিক দিক থেকে।
সাতকড়ি মাথা নেড়ে বললেন–কথাই তাই।
–তুমি কি বলচ? –আপনি যা করেন দাদা।
–তা হলে আমি বলে দিই?
–দিন।
নালু পালের দিকে ফিরে রামহরি ডানহাতের আঙ্গুলগুলো সব ফাঁক করে তুলে দেখিয়ে বললেন–পাঁচ টাকা করে লাগবে আমাদের দুজনের।
–দেবো।
–ব্রাহ্মণদের ভোজন-দক্ষিণে দিতি হবে এক টাকা।
–ওইটে কমিয়ে আট আনা করতি হবে।
–আর এক মালসা ছাঁদা দিতি হবে–লুচি, চিনি, নারকেলনাড়। খাওয়ার আগে।
–তাও দেবো, কিন্তু দক্ষিণেটা আট আনা করুন।
–আমাদের পাঁচ টাকা করে দিতে হবে, খাওয়ার আগে কিন্তু। এর কম হবে না।
–তাই দেবো। তবে কমসে কম একশো ব্রাহ্মণ এনে হাজির। করতি হবে। তার কম হলি আপনাদের মান রাখতি পারবো না।
রামহরি চক্রবর্তী মাথার মাদুলিসুদ্ধ টিকিটা দুলিয়ে বললে–আলবৎ এনে দেবো। আমার নিজের বাড়িতিই তো ভাগ্নে, ভাগ্নীজামাই, তিন খুড়তুতো ভাই, আমার নিজের চার ছেলে, দুই ছোট মেয়ে–তারা সবাই আসবে। সাতকড়ি ভায়ারও শত্তুরের মুখি ছাই দিয়ে পাঁচটি, তারাও আসবে। একশোর অর্ধেক তো এখেনেই হয়ে গেল। গেল কি না?
ক্ষমতা আছে রামহরি চক্রবর্তীর। ব্রাহ্মণভোজনের দিন দলে দলে ব্রাহ্মণ আসতে লাগলো। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের হাত ধরে। বড় উঠোনে শামিয়ানার তলায় সকলের জায়গা ধরলো না। দীয়তাং ভূজ্যতাং ব্যাপার চললো। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি আর চিনি এক এক ব্রাহ্মণে যা টানলে! দেখবার মতো হল দৃশ্যটা। কখনো এ অঞ্চলে এত বৃহৎ ও এত উচ্চশ্রেণীর ভোজ কেউ দেয় নি। যে যত পারে পেট ভরে গরম লুচি, মালপুয়া, চিনি ও নারকোলের রসকরা দেওয়া হল–তার সঙ্গে ছিল বৈকুণ্ঠপুরের সোনা গোয়ালিনীর উৎকৃষ্ট শুকো দই, এদেশের মধ্যে নামডাকী জিনিস। ব্রাহ্মণেরা ধন্য ধন্য করতে লাগলো খেতে খেতেই। কে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বললে–বাবা নালু, পড়াই ছিল কুলীনকুলসর্বস্ব নাটকে–
ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি, দুচারি আদার কুচি।
কচুরি তাহাতে খান দুই
খাই নি কখনো। কে খাওয়াচ্চে এ গরিব অঞ্চলে? তা আজ বাবা তোমার বাড়ি এসে খেয়ে
সকলে সমস্বরে বলে উঠলো–যা বললেন, দাদামশায়। যা বললেন–
দক্ষিণা নিয়ে ও ছাঁদার মালসা নিয়ে ব্রাক্ষণের দল চলে গেলে দালাল রামহরি চক্রবর্তী নালু পালের সামনে এসে বললেন—কেমন পালমশায়? কি বলেছিলাম আপনারে? ভাত ছড়ালি কাকের অভাব?
নালু পাল সঙ্কুচিত হয়ে হাতজোড় করে বললে–ছি ছি, ও কথা বলবেন না। ওতে আমার অপরাধ হয়। আমার কত বড় ভাগ্যি আজকে, যে আজ আমার বাড়ি আপনাদের পায়ের ধুলো পড়লো। আপনাদের দালালি নিয়ে যান। ক্ষ্যামতা আছে আপনাদের।
–কিছু ক্ষ্যামতা নেই। এ ক্ষ্যামতার কথা না পালমশাই। সত্যি কথা আর হক কথা ছাড়া রামহরি বলে না। তেমন বাপে জম্মো দেয় নি। লুচি চিনির ফলার এ অঞ্চলে কদিন কজনে খাইয়েচে শুনি? ঐ নাম শুনে সবাই ছুটে এসেচে। এ গাঁয়ের কেউ বুঝি আসে নি? তা আসবে না। এদের পায়াভারি অনেক কিনা!
–একজন এসেচেন, ভাবানী বাঁড়ুয্যে মশাই।
রামহরি আশ্চর্য হয়ে বললেন–কি রকম কথা দেওয়ানজির জামাই?
–তিনিই।
–আমার সঙ্গে একবার আলাপ করিয়ে দ্যান না পালমশাই?
সব ব্রাহ্মণের খাওয়া চুকে যাওয়ার পরে ভবানী বাঁড়ুয্যে খোকাকে নিয়ে নিরিবিলি জায়গায় বসে আহার করছিলেন। খোকা জীবনে লুচি এই প্রথম খেলে। বলছিল–এরে নুচি বলে বাবা?