নিস্তারিণী ঘাটভরা বৌ-ঝিদের দিকে একবার তাচ্ছিল্যভরা চোখে চেয়ে দেখে নিয়ে অনেকটা যেন আপন মনে বললে, তেঁতুল কুটতে কুটতে বেলা টের পাই নি!
–ওমা, আমরাও আজ তেঁতুল কুটছিলাম রে। নিলু আর আমি। আমাদের ওপর রাগ হয়েচে নাকি?
–সেডা কি কথা? কেন?
–আমাদের বাড়িতে যাস্ নি কদিন।
–কখন যাই বলো ঠাকুরঝি। ক্ষার সেদ্ধ করলাম, ক্ষার কাচলাম। চিড়ে কোটা, ধান ভানা সবই তো একা হাতে করচি। শাশুড়ি আজকাল আর লগি দ্যান না বড় একটা–
নিস্তারিণী সুরূপা বৌ, যদিও তার বয়েস হয়েচে এদের অনেকের চেয়ে বেশি। তার হাত-পা নেড়ে ঠোঁটের হাসি ঠোঁটে চেপে কথাটা বলবার ভঙ্গিতে হিমি আর বিরাজ একসঙ্গে কৌতুকে হি হি করে হেসে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে যেন কোথাকার একটা বাঁধ খুলে গেল, হাসির ঢেউয়ের রোল উঠলো চারিদিক থেকে।
হিমি বললে–নিস্তারদি কি হাসাতেই পারে! এসো না, জলে নামো নিস্তারদি।
বিরাজ বললে–সেই গানটা গান না দিদি। নিধুবাবুর–কি চমৎকার গাইতে পারেন ওটা! বিধুদিদি যেটা গাইতো।
সবাই জানে নিস্তারিণী সুস্বরে গান গায়। হাসি গানে গল্পে মজলিশ জমাতে ওর জুড়ি বৌ নেই গাঁয়ে। সেইজন্যেই মুখ ফিরিয়ে অনেকে বলে–অতটা ভালো না মেয়েমানুষের। যা রয় সয় সেডাই না ভালো।
নিস্তারিণী হাত নেড়ে গান ধরলে–
ভালবাসা কি কথার কথা সই
মন যার মনে গাঁথা
শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িত লতা–
প্রাণ যার প্রাণে গাঁথা
সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল।
কেমন হাতের ভঙ্গি, কেমন গলার সুর! কেমন চমৎকার দেখায়। ওকে হাত নেড়ে নেড়ে গান গাইলে! একজন বললেনীলবরণী গানটাও বড় ভালো গান আপনি।
নিস্তারিণীও খুশি হল। সে ভুলে গেল সাত বছর বয়েসে তার বাবা অনেক টকা পণ পেয়ে শ্রোত্রিয় ঘরে মেয়েকে বিক্রি করেছিলেন–খুব বেশি টাকা, পঁচাত্তর টাকা। খোঁড়া স্বামীর সঙ্গে সে খাপ খাইয়ে চলতে পারে নি কোনোদিন, শাশুড়ির সঙ্গেও নয়। যদিও স্বামী তার ভালোই। শ্বশুর ভজগোবিন্দ বাঁড়ুয্যে আরো ভালো। কখনো ওর মতের বিরুদ্ধে যায় নি। ইদানীং গরিব হয়ে পড়েছে, খেতে পরতে দিতে পারে না, ছেলেমেয়েদের পেটপুরে ভাত জোটে না–তবুও নিস্তারিণী খুশি থাকে। সে জানে গ্রামে তাকে ভালো চোখে অনেকেই দেখে না, না। দেখলে–বয়েই গেল! কলা! যত সব কলাবতী বিদ্যোধরী সতীসাধ্বীর। দল! মারো ঝাঁটা!
ও জলে নেমেছে। বিরাজ ওর সিক্ত সুঠাম দেহটা আদরে জড়িয়ে ধরে বললে–নিস্তারদিদি, সোনার দিদি!…কি সুন্দর গান, কি সুন্দর ভঙ্গি তোমার। আমি যদি পুরুষ হতম, তবে তোর সঙ্গে দিদি পীরিতে পড়ে যেতুম–মাইরি বলচি কিন্তু একদিন বনভোজন করবি চল।
কেন হঠাৎ নিস্তারিণীর মনে অনেকদিন আগেকার ও ছবিটা ভেসে উঠলো? মনের অদ্ভুত চরিত্র। কখন কি করে বসে সেটা কেউ বলতে পারে? সেই যে তার প্রণয়ীর সঙ্গে একদিন নদীর ধারে বসেছিল–সেই ছবিটা। আর একটা খুব সাহসের কাজ করে বসলো নিস্তারিণী। যা কখনো কেউ গাঁয়ে করে না, মেয়েমানুষ হয়ে। বললে–ঠাকুরজামাই ভালো আছেন, বড়দি?
পুরুষের কথা এভাবে জিজ্ঞেস করা বেনিয়ম। তবে নিস্তারিণীকে সবাই জানে। ওর কাছ থেকে অদ্ভুত কিছু আসাটা সকলের গা-সওয়া হয়ে গিয়েচে।
.
পুজো প্রায় এসে গেল। ফণি চক্কত্তির চণ্ডীমণ্ডপে বসে গ্রামস্থ সজ্জনগণের মজলিশ চলচে। তামাকের ধোঁয়ায় অন্ধকার হবার উপক্রম হয়েচে চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়া। ব্রাহ্মণদের জন্যে একদিকে মাদুর পাতা, অন্য জাতির জন্যে অপর দিকে খেজুরের চ্যাটাই পাতা। মাঝখান দিয়ে যাবার রাস্তা।
নীলমণি সমাদ্দার বললেন–কালে কালে কি হোলো হে!
ফণি চক্কত্তি বললেন–ও সব হোলো হঠাৎ-বড়লোকের কাণ্ড। তুমি আমি করবোড়া কি? তোমার ভালো না লাগে, সেখানে যাব না। মিটে গেল।
শ্যামলাল মুখুয্যে বললেন–তুমি যাবা না, সাবাইপুরের বামুনেরা। আসবে এখন। তখন কোথায় থাকবে মানডা?
–কেন, কি রকম শুনলে?
–গাঁয়ের ব্রাহ্মণ সব নেমন্তন্ন করবে এবার ওর বাড়ি দুর্গোৎসবে।
স্পদ্ধাডা বেড়ে গিয়েচে ব্যাটার। ব্যাটা হঠাৎ-বড়লোক কিনা!
লালমোহন পাল গ্রামের কোনো লোকের কোনো সমালোচনা না মেনে মহাধুমধামে চণ্ডীমণ্ডপে দুর্গাপ্রতিমা তুললে। এবার অনেক দুর্গাপূজা এ গ্রামে ও পাশের সব গ্রামগুলিতে। প্রতিবছর যেমন হয়, গ্রামের গরিব দুঃখীরা পেটভরে নারকোলনাড়, সরু ধানের চিড়ে ও মুড়কি খায়। নেমন্তন্ন কবাড়িতে খাবে? সুতুনি, কচুরশাক, ডুমুরের ডালনা, সোনামুগের ডাল, মাছ ও মাংস, দই, রসকরা সব বাড়িতেই। লালমোহন পালের নিমন্ত্রণ এ গাঁয়ের কোনো ব্রাহ্মণ নেন নি। এ পর্যন্ত নালু পাল ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে এসেচে পরের বাড়িতে টাকা দিয়ে… কিন্তু তার নিজের বাড়িতেই ব্রাহ্মণভোজন হবে, এতে সমাজপতিদের। মত হল না। নালু পাল হাতজোড় করে বাড়ি বাড়ি দাঁড়ালো, ফণি চক্কত্তির চণ্ডীমণ্ডপে একদিন এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে ফুলবেঞ্চের বিচার চললো। শেষ পর্যন্ত ওর আপিল ডিসমিস হয়ে গেল।
তুলসী এল ষষ্ঠীর দিন তিলু-নিলুর কাছে। কস্তাপেড়ে শাড়ি পরনে, গলায় সোনার মুড়কি মাদুলি, হাতে যশম। গড় হয়ে তিলুর পায়ের কাছে প্রণাম করে বললে–হ্যাঁ দিদি, আমার ওপরে গাঁয়ের ঠাকুরদের এ কি অত্যাচার দেখুন!
–সে সব শুনলাম।