এ পাড়ায় ইছামতীতে মাত্র দুটি নাইবার ঘাট, একটার নাম রায়পাড়ার ঘাট, আর একটার নাম সায়েবের ঘাট। কিছুদূরে বাঁকের মুখে বনশিমতলার ঘাট। পাড়া থেকে দূরে বলে বনশিমতলার ঘাটে মেয়েরা আদৌ আসে না, যদিও সবগুলো ঘাটের চেয়ে তীরতরুশ্রেণী এখানে বেশি নিবিড়, ধরার অরুণোদয় এখানে অবাচ্য সৌন্দর্য ও মহিমায় ভরা, বনবিহঙ্গকাকলি এখানে সুস্বরা, কত ধরনের যে বনফুল ফোটে ঋতুতে ঋতুতে এর তীরের বনে বনে, ঝোপে ঝোপে! চাঁড়াগাছের তলায় কি ছায়াভরা কুঞ্জবিতান, পঞ্চাশ-ষাট বছরের মোটা চাঁড়াগাছ। এখানে খুঁজলে দুচারটে মিলে যায়।
তিলু বললে–চল না, বনশিমতলার ঘাটে নাইতে যাই—
বিরাজ বললে–এই অবেলায়?
–কদ্দূর আর!
–যেতুম ভাই, কিন্তু শাশুড়ি বাড়ি নেই, দুটি ডাল ভেঙ্গে উঠোনে রোদে দিয়ে গ্যাছেন, তুলে আসতে ভুলে গেলুম আসবার সময়। গোরু-বাছুরে খেয়ে ফেললে আমাকে বুঝি আস্ত রাখবেন ভেবেচ!
নিলু বললেও সব কিছু শুনচি নে। যেতেই হবে বনশিমতলার ঘাটে। চলো।
বিরাজ হেসে সুন্দর চোখ দুটি তেরচা করে কটাক্ষ হেনে বললে– কেন, কোনো নাগর সেখানে ওত পেতে আছে বুঝি?
তিল বললে–আমাদের বুড়োবয়সে আর নাগর কি থাকবে ভাই, ওসব তোদের কাঁচা বয়সের কাণ্ড। একটা ছেড়ে ঘাটে ঘাটে তোদের নাগর থাকতি পারে।
-ইস! এখনো ওই বয়সের রূপ দেখলে অনেক যুবোর মুণ্ডু ঘুরে। যাবে একথা বলতে পারি দিদি। চলো, চলো, দেখি কোন্ ঘাটে নিয়ে। যাবে! নাগরের চক্ষু ছানাবড়া করে দিয়ে আসি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রায়পাড়ার ঘাটেই ওদের যেতে হল, পথে নামবার পরে অনেক ঝি-বৌ ওদের ধরে নিয়ে গেল। ঘাটে অনেক ঝি বৌ, হাসির ঢেউ উঠচে, গরম দিনের শেষে ঠাণ্ডা নদীজলের আমেজ লেগেচে সকলের গায়ে, জলকেলি শেষ করে সুন্দরী বধূ-কন্যার দল কেউ ডাঙায় উঠতে চায় না।
সীতানাথ রায়ের পুত্রবধূ হিমি ডেকে বললে–ও বড়দি, দেখি নি যে কদ্দিন!
তিলু বললে–এ ঘাটে আর আসিনে–
–কেন? কোন্ ঘাটে যান তবে?
বিরাজ বললে–তারা খবর দিস তোদের লুকোনো নাগরালির? ও কেন বলবে ওর নিজের? আমি তো বলতুম না!
হিমি বললে–বড়দিদির বয়েসটা আমার মার বয়সী। ওকথা আর ওঁকে বোলো না। তোমার মুখ সুন্দর, বয়েস কচি, ওসব তোমাদের। কাজ। ওতে কি?
–এতে ভাই খোল। গা-টায় ময়লা হয়েচে, ক্ষারখোল মাখবো বলে নিয়ে এলুম। মাখবি?
–না। তুমি সুন্দরী, তুমি ওসব মাখো।
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো। এতগুলি তরুণীর হাসির লহরে, কথাবার্তার ঝিলিকে স্নানের ঘাট মুখর হয়ে উঠেছে, আর কিছু পরে সপ্তমীর চাঁদ উঠবে ঘাটের ওপরকার শিরীষ আর পুয়োঁ গাছের মাথায়। পটপটি গাছের ফুল ঝরে পড়চে জলের ওপর, বিরাজের মনে। কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দের ভাব এল, যেন এ সংসারে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, তার রূপের প্রশংসা সব স্থানে শোনা যাবে, বড় পিড়িখানা এয়োস্ত্রী সমাজে তার জন্যেই পাতা থাকবে সর্বত্র। ফেনিবাতাসার থালা তার দিকে এগিয়ে ধরবে সবাই চিরকাল, কোন কুয়াশা-ছাড়া পাখি-ডাকা ভোরে শাঁখ বাজিয়ে ডালা সাজিয়ে জল সইতে বেরুবে তার খোকার অন্নপ্রাশনে কি বিয়ে-পৈতেতে, শান্তিপুরি শাড়ি পরে সে ফুলের সাজি আর তেলহলুদের কাঁসার বাটি নিয়ে ঝামর ঝমর মল বাজিয়ে, গুজরীপঞ্চম আর পৈঁছে পরে সেজেগুজে চলবে এয়োস্ত্রীদের আগে আগে…আরো কত কি কত কি মনে আসে…মনের খুশিতে সে টুপটুপ করে ডুব দেয়, একবার ডুব দিয়ে উঠে সে যেন সামনের চরের প্রান্তে উদার আকাশের কোণে দেখতে পেলে তার মায়ের হাসিমুখ, আর একবার দেখলে বিয়ের ফুলশয্যার রাতে ছোবা খেলা। করতে করতে উনি আড়চোখে তার দিকে চেয়েছিলেন, সেই সলজ্জ, সসঙ্কোচ হাসি মুখখানা।…
জীবনে শুধু সুখ! শুধু আনন্দ! শুধু খাওয়াদাওয়া, জলকেলি, হাসিখুশি, কদম্বকেলি, তাস নিয়ে বিন্তি খেলার ধুম! হি হি হি-কি মজা!
–হ্যাঁরে, ওকি ও বিরাজদিদি, অবেলায় তুই জলে ডুব দিচ্ছিস কি মনে করে?
অবাক হয়ে হিমি বললে কথাটা।
নিলু বললে–তাই তো, দ্যাখ বড়দি, কাণ্ড। হ্যাঁরে চুল ভিজুলি যে, ওই চুলডার রাশ শুকুবে? কি আক্কেল তোর?
বিরাজের গ্রাহ্য নেই ওদের কথার দিকে। সে নিজের ভাবে নিজে বিভোরা, বললে–এই। একটা গান গাইবো শুনবি?
মনের বাসনা তোরে সবিশেষ শোন রে বলি—
হিমি বললে–ওরে চুপ, কে যেন আসচে-ভারিক্কি দলের কেউ—
নিস্তারিণী গুল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ঘাটের ওপর এসে হাজির হল। সবাই একসঙ্গে তাকে দেখলে তাকিয়ে, কিন্তু কেউ কথা বললে না। এ গাঁয়ের ঝি-বৌদের অনেকেই ওর সঙ্গে কথা বলে না, ওর সম্বন্ধে নানারকম কথা রটনা আছে পাড়ায় পাড়ায়। কেউ কিছু দেখে নি, বলতে পারে না, তবুও ওর পাড়ার রাস্তা দিয়ে একা একা বেরুনো, যার তার সঙ্গে মেয়েমানুষদের মধ্যে) কথা বলা–এ সব নিয়ে ঘরে ঘরে কথা হয়েচে। এইসব জন্যেই কেউ ওর সঙ্গে হঠাৎ কথা বলতে চায় না সাহস করে, পাছে ওর সঙ্গে কথা কইলে কেউ খারাপ বলে।
তিলু ও নিলুর সাতখুন মাপ এ গাঁয়ে। তিলু কোনো কিছু মেনে চলার মতো মেয়েও নয়, সবাই জানে। কিন্তু মজাও এই, তার বা তাদের কবোনের নামে কখনো এ গাঁয়ে কিছু রটে নি। কেন তার কারণ বলা শক্ত। তিলু মমতাভরা চোখের দৃষ্টি নিস্তারিণীর দিকে তুলে বললে–আয় ভাই, আয়। এত অবেলা?