ময়নাও সুর চড়িয়ে বলতে লাগলো–গিয়েচে যাক। আর অত দরদ দেখাতি হবে না, বলে মার চেয়ে যার দরদ তারে বলে ডান!…দ্যাও তুমি ওকে নামিয়ে
তুলসী বললে–না, দেবো না। আমার চকির সামনে রোগী ছেলেডারে তুমি কক্ষনো গায়ে হাত দিতি পারব না–ছেলেটাকে কোলে করে তুলসী নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিল।
বেশি বেলায় লালমোহন পাল আড়ত থেকে বাড়ি ফিরে দেখলে তুলসী রান্না করচে, ছেলেপুলেদের ভাত দেওয়া হয়েচে। দাদাকে দেখে ময়না পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলো। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির সাধ তার খুব পুরেচে। যেদিন মা মরে গিয়েচে, সেই দিনই বাপের বাড়ির দরজায় খিল পড়ে গিয়েচে তার। ইত্যাদি।
লালমোহন বললে হ্যাঁগা, আবার আজ কি বাধালে তোমরা? খেটেখুটে আসবো সারা দিন ভূতির মতো। বাড়িতি এসে একটু শান্তি নেই?
তুলসী কোনো কথা বললে না, কারো কোনো কথার জবাব দিলে। স্বামীর তেল, গামছা এনে দিলে। ঝিকে দিয়ে জলচৌকি পাতিয়ে দুঘড়া নাইবার জল দিয়ে বললে–স্নান করে দুটো খেয়ে নাও দিকি।
–না, আগে বলো, তবে খাবো।
-তুমিও কি অবুঝ হলে গা? আমি তবে কার মুখির দিকি তাকাবো! খেয়ে নাও, বলছি।
সব শুনে লালমোহন রেগে বললে–এত অশান্তি সহ্য হয় না। আজই দুটোরে দুজায়গায় করি। যখন বনে না তোমাদের, তখন
তুলসী সত্যি ধৈর্যশীলা মেয়ে। বোবার শক্র নেই, সে চুপ করে রইল। ময়না কিছুতেই খাবে না, অনেক খোশামোদ করে হাত জোড় করে তাঁকে খেতে বসালে। তাকে খাইয়ে তবে তৃতীয় প্রহরের সময় নিজে খেতে বসলো।
সন্ধ্যার আগে ওপাড়ার যতীনের বোন নন্দরাণী এসে বললেও বৌদিদি, একটা কথা বলতি এসেছিলাম, যদি শোনো তো বলি–
তুলসী পিঁড়ি পেতে তাকে বসালে। পান সেজে খেতে দিলে নিজে। নন্দরাণী বললে–একটা টাকা ধার দিতি হবে, হাতে কিছু নেই। কাল সকালে কি যে খাওয়াবো ছেলেটাকে–জানো সব তত বৌদি। বাবার খ্যামতা ছিল না, যাকে তাকে ধরে বিয়ে দিয়ে গ্যালেন। তিনি তো চক্ষু বুজলেন, এখন তুই মর–
তুলসী যাচককে বিমুখ করে না কখনো। সেও গরিব ঘরের মেয়ে। তার বাবা অম্বিক প্রামাণিক সামান্য দোকান ও ব্যবসা করে তাদের কষ্টে মানুষ করে গিয়েছিলেন। তুলসী সেকথা ভোলে নি। নন্দরাণীকে বললে–যখন যা দরকার হবে, আমায় এসে বলবেন ভাই। এতো লজ্জা করবেন না। পর না ভেবে এসেছেন যে, মনডা খুশি হোলো বড়ড়। আর একটা পান খান–দোক্তা চলবে? না? স্বর্ণদিদি ভালো আছেন?…
নন্দরাণী টাকা নিয়ে খুশিমনে বাড়ি চলে গেল সেদিন সন্দের আগেই। ঝিকে তুলসী বললে-ষষ্ঠীতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয় দিদিকে—
.
তিল ও নিলু তেতুল কুটছিল বসে বসে। চৈত্র মাসের অপরাহ্ন। একটা খেজুরপাতার চেটাই বিছিয়ে তার ওপর বসে নিলু তেঁতুল কুটছিল, তিলু সেগুলো বেছে বেছে একপাশে জড়ো করছিল।
–কোন্ গাছের তেঁতুল রে?
–তা জানি নে দিদি। গোপাল মুচির ছেলে ব্যাংটা পেড়ে দিয়ে গেল।
–গাঙের ধারের?
–সে তো খুব মিষ্টি। খেয়ে দ্যাখ না!
তিলু একখানা তেঁতুল মুখে ফেলে দিয়ে বললে–বাঃ, কি মিষ্টি! গাঙের ধারের ওই বড় গাছটার!
–তাড়াতাড়ি নে দিদি। খোকা পাঠশালা থেকে এল বলে। এলেই মুখি পুরবে।
–হ্যাঁরে, বিলুর কথা মনে পড়ে? তিনজনে বসে তেঁতুল কুটতাম এরকম, মনে পড়ে?
–খুব।
দুই বোনই চুপ করে রইল। অনেক কথাই মনে পড়ে। এই তো কয়েক বছর হল বিলু মারা গিয়েচে। মনে হচ্চে কত দিন, কত যুগ। এইসব চৈত্র মাসের দুপুরে বাঁশবনের পত্র-মর্মরে, পাপিয়ার উদাস ডাকে যেন পুরাতন স্মৃতি ভিড় করে আসে মনের মধ্যে। বাপের মতো দাদা–মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে যে দাদা, যে বৌদিদি বাবা-মায়ের মতোই তাদের মানুষ করেছিলেন, তাদের কথাও মনে পড়ে।
পাশের বাড়ির শরৎ বাঁড়ুয্যের বৌ হেমলতা পান চিবুতে চিবুতে এসে বললে–কি হচ্চে বৌদিদি? তেঁতুল কুটচো?
তিলু বললে–এ আর কখানা তেঁতুল! এখনো দুঝুড়ি ঘরে রয়েছে। তালপাতার চ্যাটাইখানা টেনে বোসো।
–বসবো না, জানতি এয়েলাম আজ কি তিতোদশী? বেগুন খেতি আছে?
–খুব আছে। দোয়াদশী পুরো। রাত দুপহরে ছাড়বে। তোমার দাদা বলছিলেন।
–দাদা বাড়ি?
–না, কোথায় বেরিয়েচেন। দাদা কেমন আছেন?
–ভালো আছেন। বুড়োমানুষের আর ভালো-মন্দ! কাশি আর জ্বরডা সেরেচে। টুলু কোথায়?
–এখনো পাঠশালা থেকে ফেরে নি বৌদি।
–অনেক তেতুল কুটচিস্ তোরা। আমাদের এ বছর দুটো গাছের তেঁতুল পেড়ে ন দেবা ন ধম্মা। মুড়ি মুড়ি পোকা তেঁতুলির মধ্যি। দুটো কোটা তেতুল দিস সেই শ্রাবণ মাসে অম্বলতা খাবার জন্যি। খয়রা মাছ দিয়ে অম্বল খেতি তোমার দাদা বড় ভালবাসেন।
বেলা পড়ে এসেচে। কোকিল ডাকচে বাঁশঝাড়ের মগডালে। কোথা থেকে শুকনো কুলের আচারের গন্ধ আসচে। কামরাঙা গাছের তলায় নলে নাপিতদের দুটো হেলে গোরু চরে বেড়াচ্চে। ওপাড়ার সতে চৌধুরীর পুত্রবধূ বিরাজমোহিনী গামছা নিয়ে নদীতে গা ধুতে গেল। সামনের রাস্তা দিয়ে।
নিলু ডেকে বললে–ও বিরাজ, ও বিরাজ
বিরাজমোহিনী নথ বাঁ হাতে ধরে ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে– কি?
–দাঁড়া ভাই।
–যাবে ছোড়দি?
–যাবো।
বিরাজের বাপের বাড়ি নদে শান্তিপুরের কাছে বাঘআঁচড়া গ্রামে। সুতরাং তার বুলি যশোর জেলার মতো নয়, সেটা সে খুব ভালো করে জাহির করতে চায় এ অজ বাংলা দেশের ঝি-বৌদের কাছে। ওর সঙ্গে তিলু নিলু দুই বোনই গেল ঘরে শেকল তুলে দিয়ে।