নীরি হি-হি করে উচ্চরবে যে হাসিটা হেসে উঠলো, তার মধ্যেকার শ্লেষের সুর ওর কানে বড় বেশি করে যেন বাজলো। কাল সকালে উঠেই সে চলে যাবে এখান থেকে।
দুঃখিত হয়ে বললে–অত হাসি কেন? সত্যি জানি নে। আমি মিথ্যে বলবো এ নিয়ে নীরি?
নীরি তাকে বোঝাতে বসলো জিনিসটা কাকে বলে। বড় পরিশ্রমের কাজ, সকালে উঠে চেঁকিতে পাড় দিতে হবে দুপুর পর্যন্ত। ধান সেদ্ধ করতে হবে। তার জন্যে কাঠকুটো কুড়িয়ে জড়ো করতে হবে। চৈত্র মাসে শুকনো বাঁশপাতা কুমোরদের বাজরা পুরে কুড়িয়ে আনতে হবে বাঁশবাগান থেকে। সারা বছর উনুন ধরাতে হবে তাই দিয়ে। চিড়ে ঝাড়তে ঝাড়তে দুহাত ব্যথায় টনটন করবে। কথা শেষ করে নীরি বললে–সে তুই পারবি নে, পারবি নে। পিসিমা তোরে মানুষ করে গিয়েল অন্যভাবে। তোর আখের নষ্ট করে রেখে গিয়েচে। না হলি মেমসায়েব, না হলি বাগদিঘরের ভাঁড়ানী মেয়ে! কি করে তুই চালাবি? দুকূল হারালি।
গয়া আর কোনো কথা বললে না।
তার নিজের কপালের দোষ। কারো দোষ নয়। এরা দিন পেয়েচে, এখন বলবেই। আর কারো কাছে দুঃখু জানাবে না সে। এরা আপনজন। নয়। এরা শুধু ঠেস্ দিয়ে কথা বলে মজা দেখবে।
নীরি বললে-দোক্তা খাবি?
–না ভাই।
এবার একটু ঘুমুই।
–তোমার সুখের শরীল। রাত জাগা অভ্যেস থাকতো আমাদের মতো তো ঠ্যালাটি বুঝতে! পুজোর সময় পরবের সময় সারারাত জেগে চিড়ে কুটিচি, ছাতু কুটিচি, ধান ভেনেচি। নইলে খদ্দের থাকে? রাত একটু জাগতি পারো না, তুমি আবার পাঁচাদরে ধান ভানবা, তবেই হয়েচে!
গয়া খুব বেশি ঝগড়া করতে পারে না। সে অভ্যাস তার গড়ে ওঠে নি পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের মতো। নতুবা এখুনি তুমুল কাণ্ড বেধে যেতো। নীরির সঙ্গে। একবার ইচ্ছে হল নীরির কুটুনির সে উত্তর দেবে ভালো করেই। কিন্তু পরক্ষণেই তার বহুদিনের অভ্যস্ত ভদ্রতাবোধ তাকে বললে, কেন বাজে চেঁচামেচি করা? ঘুমিয়ে পড়ো, ও যা বলে বলুক গে। ওর কথায় গায়ে ঘা হয়ে যাবে না। নীরি কি জানবে মনের কথা?
প্রসন্ন খুড়োমশায়ের সঙ্গে কতকাল দেখা হয় নি। কোথায় চলে গিয়েচেন নীলকুঠির কাছারিতে বরখাস্ত হয়ে। তবুও একজন লোক ছিল, অসময়ে খোঁজখবর নিত। আকাট নিষ্ঠুর সংসারে এই আর একজন যে তার মুখের দিকে চাইতো। অবহেলা হেনস্থা করেছে তাকে একদিন গয়া। আজ নীরির মুখের দোক্তা-তামাকের কড়া গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কেবলই মনটা হু-হু করচে সেই কথা মনে হয়ে। আজ তিনিও নেই।
কবিরাজ ঠাকুরের এখানে এসে তবু যেন খানিকটা শান্তি পাওয়া যাচ্চে অনেকদিন পরে। কারা যেন কথা বলে এখানে। সে কথা কখনো শোনে নি। মনে নতুন ভরসা জাগে।
তুলসী সকালে উঠে ছেলেমেয়েদের দুটো মুড়ি আর নারিকেলনাড় খেতে দিলে। ঝি এসে বললে–মা, বড় গোয়াল এখন ঝাঁটপষ্কার করবো, না থাকবে?
–এখন থাক গে। দুধ দোওয়া না হলি, গোরু বের না হলি গোয়াল পুঁছে লাভ নেই। আবার যা তাই হবে।
ময়না এখানে এসেছে আজ দুমাস। তার ছোট ছেলেটার বড় অসুখ। রামকানাই কবিরাজকে দেখাবার জন্যেই ময়না এখানে এসে আছে ছেলেপুলে নিয়ে। ময়নার বিয়ে অবস্থাপন্ন ঘরে দিতে পারে। নি লালমোহন, তখন তার অবস্থা ভালো ছিল না। সেজন্যে ময়নাকে প্রায়ই এখানে নিয়ে আসে। দাদার বাড়িতে দুদিন ভালো খাবে পরবে। তুলসী ভালো মেয়ে বলেই আমরা এসব সম্ভব হয়েচে বেশি করে। ময়না বেশিদিন না এলে তুলসী স্বামীকে তাগাদা দেয়–হ্যাঁগা, হিম হয়ে বসে আছ (এ কথাটা সে খুব বেশি ব্যবহার করে) যে! ময়না ঠাকুরঝি সেই কবে গিয়েচে, মা-বাপই না হয় মারা গিয়েচে, তুমি দাদা তো আছ–মাও তো বেশিদিন মারা যান নি, ওকে নিয়ে এসো গিয়ে।
ময়নার মা মারা গিয়েছিলেন–তখন নালুর গোলাবাড়ি, দোকান ও আড়ত হয়েচে, তবে এমন বড় মহাজন হয়ে ওঠে নি। নালু পালের একটা দুঃখ আছে মনে, মা এসব কিছু দেখে গেলেন না। তুলসী। এখানে এলে ময়নাকে আরো বেশি করে যত্ন করে, শাশুড়ির ভাগটাও যেন ওকে দেয়। বরং ময়না খুব ভালো নয়, বেশ একটু ঝগড়াটে, বাল্যকাল থেকেই একটু আদুরে। পান থেকে চুন খসলে তখুনি সতেরো কথা শুনিয়ে দেবে বৌদিকে।
কিন্তু তুলসী কখনো ব্যাজার হয় না। অসাধারণ সহ্যগুণ তার। যেমন আজই হল। হঠাৎ মুড়ি খেতে খেতে তুলসীর মেয়ে হাবি ময়নার ছোট ছেলের গালে এক চড় মারলে। ছেলেতে ছেলেতে ঝগড়া, তাতে ময়নার যাবার দরকার ছিল না। সে গিয়ে বললে–কি রে, কেষ্টকে মারলে কেডা?
সবাই বলে দিলে, হাবি মেরেচে, মুড়ি নিয়ে কি ঝগড়া বেধেছিল দুজনে।
ময়না হাবিকে প্রথমে দুড়দাড় করে মারলে, তারপর বকতে শুরু করলে–তোর বড় বড় হয়েচে, আমার রোগা ছেলেটার গায়ে হাত তুলিস, ওর শরীলি আছে কি? ও মরে গেলে তোমাদের হাড় জুড়োয়! ওতে মায়েরও আস্কারা আছে কিনা, নইলে এমন হতি পারে?
তুলসী শুনে বাইরে এসে বললে–হ্যাঁ ঠাকুরুঝি, আমার এতে কি আস্কারা আছে? বলি আমি বলবো তোমার ছেলেকে মারতি, কেন সে কি আমার পর?
ময়না ইতরের মতো ঝগড়া শুরু করে দিলে। শেষকালে রোগা ছেলেটাকে ঠাস ঠাস করে গোটাকতক চড় বসিয়ে বললে–মর না তুই আপদ! তোর জন্যিই তো দাদার পয়সা খরচ হচ্ছে বলে ওদের এত রাগ। মরে যা না–
তুলসী অবাক হয়ে গেল ময়নার কাণ্ড দেখে। সে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বললে–খেপলে না পাগল হলে? কেন মেরে মরচিস রোগা ছেলেটাকে অমন করে? আহা, বাছার পিঠটা লাল হয়ে গিয়েচে!