রাজারাম জোর করে নীলের দাগ মেরে এসেছেন পাঁচু শেখের ও তার শ্বশুর বিপিন গাজি ও নবু গাজির জমিতে। এরা সে গ্রামের মধ্যে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, বিপিন গাজির বাড়িতে আটটি ধানবোঝাই গোলা, বিশ-পঁচিশটি হালের বলদ, ছজোড়া লাঙল। তার ভাই নবু গাজি তেজারতি কারবারে বেশ ফেপে উঠেছে আজকাল। কমপক্ষেও একশো বিঘে আউশ ধানের চাষ হয় দুই ভায়ের জোতে। গ্রামের সব লোকে ওদের সমীহ করে চলে, এরাও বিপদে-আপদে সবসময় বুক দিয়ে পড়ে।
নবু গাজি আজ ছোটসাহেবের কাছে এসে নালিশ করেছে। তাই বোধ হয় ছোটসাহেব ডেকেচেন। কি জানি। রাজারাম ভয় খান না। নবু গাজি কি করতে পারে করুক।
ছোটসাহেব অনেকদিন এদেশে থেকে এদেশের গ্রাম্যলোকের মতো বাংলা বলতে পারে। রাজারামকে ডেকে বললে–কি বলছিল নবু গাজি, ও রাজারাম!
–কি বলুম হুজুর
–ওর তামাকের জমিতে নাকি দাগ মেরে এসেচ।
–না মারলি ও গাঁ জব্দ রাখা যাবে না হুজুর।
–ও বলচে ওদের পীরির দরগার সামনের জমিও নিয়ে?
–মিথ্যে কথা হুজুর। আপনি ডাকান ওকে।
নবু গাজি বেশ জোয়ান মর্দ লোক, ঠাণ্ডা প্রকৃতির লোকও সে নিতান্ত নয়। কিন্তু ছোটসাহেব ও দেওয়ানজির সামনে সে নিরীহের মতো এসে দাঁড়ালো নীলকুঠির চতুঃসীমার মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে কথা বলবার সাধ্য নেই কোনো রায়তের।
ছোটসাহেব বললে–কি নবু গাজি, এবার গুড়-পাটালি করেছিলে?
নবু গাজি বিনম্ৰসুরে বললে–না সায়েব, মোরা এবার গাছ ঝুড়ি নি এখনো।
–পাটালি হলি খাতি দেবা না?
–আপনাদের দেবো না তো কাদের দেবো বলুন।
–দেবা ঠিক?
–ঠিক সায়েব।
–রাজারাম, তুমি এদের দরগাতলার জমিতে দাগ মেরেচ?
–না হুজুর। জমির নাম দরগাতলার জমি, এই পর্যন্ত। পুরানা খাতাপত্রে তাই আছে। সেখানে পীরের দরগা বা মসজিদ আছে কি না ওকেই জিজ্ঞেস করুন না। আছে সেখানে তোমাদের দরগা?
–ছেল আগে। এখন নেই দেওয়ানবাবু।
–তবে? তবে যে বড় মিথ্যে কথা বললে সায়েবকে?
–বাবু, আপনি একটু দয়া করুন, ও জমিতি মোরা হাজৎ করি। অঘ্রান মাসের সংক্রান্তির দিন পীরের নামে বেঁধে বেড়ে খাই। হয়–হয় আপনি একদিন দেখে আসবেন। মুই মিথ্যে কথা কেন বলবো আপনারে, আপনারা হলেন দেশের রাজা। আমার জমিটা ছেড়ে দ্যান দয়া করে।
ছোটসাহেব রাজারামের দিকে চেয়ে সুপারিশের সুরে বললে–যাক গে, দাও ছেড়ে জমিটা। ওরা কি যে করে বলচে
নবু গাজি বললে–হাজৎ।
–সেটা কি আবার?
-ওই যে বললাম সায়েব, খোদার নামে ভাত-গোস্ত বেঁধে ফকির মিচকিনিদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যা থাকে মোরা সবাই মেলে খাই।
ছোট সাহেব খুশি হয়ে বলে উঠলো–বেশ, বেশ। আমারে একদিন দেখতি হবে।
–তা দেখাবো সায়েব।
–বেশ। রাজারাম, ওর জমিটা ছেড়ে দিও। যাও
নবু গাজি আভূমি সেলাম করে চলে গেল! কিন্তু সে বোকা লোক নয়, দেওয়ান রাজারামকে সে ভালোভাবেই চেনে। বাইরে গিয়ে গাছের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাজারাম ছোটসাহেবকে বললেন–হুজুর, আপনি কাজ মাটি করলেন একেবারে।
–কেন?
–ও জমি এক নম্বরের জমি। বিঘেতে সাড়ে তিনমণ খুঁড়ো পড়তা হবে। ও জমি ছেড়ে দিতে আছে? আর যদি অমন করে আস্কারা দ্যান। প্রজাদের, তবে আমারে আর কি কেউ মানবে?–না কোনো কথা আমার কেউ শুনবে?
ছোটসাহেব শিস দিতে দিতে চলে গেল। রাজারাম রাগে অভিমানে ফুলে উঠলেন। তখনি সদর আমিন প্রসন্ন চক্কত্তির ঘরে গিয়ে কি পরামর্শ করলেন দুজনে। প্রসন্ন চক্কত্তির বয়েস চল্লিশের ওপরে, বেশ কালো রং, দোহারা গড়ন, খুব বড় এক জোড়া গোঁফ আছে, চোখগুলো গোল গোল ভাঁটার মতো। সকলে বলে অমন বদমাইশ লোক নীলকুঠির কর্মচারীদের মধ্যে আর দুটি নেই। হয়কে নয় এবং নয়কে হয় করার ওস্তাদ। আমিনদের হাতে অনেক ক্ষমতাও দেওয়া আছে। সরল গ্রাম্য প্রজারা জরিপ কার্যের জটিল কর্মপ্রণালী কিছুই বোঝে না, রামের জমি শ্যামের ঘাড়ে এবং শ্যামের জমি যদুর ঘাড়ে চাপিয়ে মিথ্যে মাপ। মেপে নীলের জমি বার করে নেওয়াই আমিনের কাজ। প্রজারা ভয় করে, সুতরাং ঘুষও দেয়। রাজারামের অংশ আছে ঘুষের ব্যাপারে। প্রসন্ন চক্কত্তি থেলো হুঁকোয় তামাক টানতে টানতে বললেন–এ রকম কল্লি তো আমাদের কথা কেউ শোনবে না, ও দেওয়ানজি!
রাজারাম সেটা ভালোই বোঝেন। বললেন–তা এখন কি করা যায়। বলো, পরামর্শ দাও।
বড়সায়েবকে বলুন কথাটা।
–সে বাঘের ঘরে এখন যাবে কেডা?
–আপনি যাবেন, আবার কেডা?
বড়সাহেব শিপটন বেজায় রাশভারী জবরদস্ত লোক। ছোটসাহেবের মন একটু উদার, লোকটা মাতাল কিনা। সবাই তো তাই বলে। বড়সাহেবের কাছে যেতে সাহস হয় না যার তার। কিন্তু মানের দায়ে যেতে হল রাজারামকে। শিপটন মুখে বড় পাইপ টানছেন বসে, হাতখানেক লম্বা পাইপ। কি সব কাগজপত্র দেখছেন। তক্তপোশের মতো প্রকাণ্ড একটা ভারি টেবিলের ধারে কাঁঠাল কাঠের একটা বড় চেয়ার। সাতবেড়ের মুসাব্বর মিস্ত্রিকে দিয়ে টেবিল চেয়ার বড়সাহেবই। তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের হাতে পালিশ আর রং করেছেন। টেবিলের একধারে মোটা চামড়াবাঁধানো একরাশ খাতা। দেওয়ালে। অনেকগুলো সাহেব-মেমের ছবি। এই ঘরের এক কোণে ফায়ার প্লেস, তেমন শীত না পড়লেও কাঠের মোটা মোটা ডালের আগুন মাঘের শেষ পর্যন্ত জ্বলে।
বড়সাহেব চোখ তুলে দেয়ালের দিকে চেয়ে বললেন–গুড মর্নিং।