ব্যায়াম ব্যতিরেকে আর সকল বিদ্যায় বৈশম্পায়ন চন্দ্রাপীড়ের অনুরূপ হইলেন। শৈশবাবধি একত্র বিদ্যাভ্যাস প্রযুক্ত পরস্পরের অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট মিত্রতা জন্মিল। বৈশম্পায়ন ব্যতিরেকে রাজকুমার একমুহূর্ত্তও একাকী থাকিতে পারিতেন না। বৈশম্পায়ন সর্ব্বদা রাজকুমারের নিকটবর্ত্তী থাকিতেন। এই রূপে বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস করিতে করিতে শৈশবকাল অতীত ও যৌবনকাল সমাগত হইল। চন্দ্রোদয়ে প্রদোষের যেরূপ রমণীয়তা হয়, গগনমণ্ডলে ইন্দ্রধনু উদিত হইলে বর্ষাকালের যেরূপ শোভা হয়, কুসুমোদ্গমে কল্পপাদপের যেরূপ শ্রী হয়, যৌবনারম্ভে রাজকুমার সেইরূপ পরমরমণীয়তা ধারণ করিলেন। বক্ষঃস্থল বিশাল, ঊরুযুগল মাংসল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, ভুজদ্বয় দীর্ঘ, স্কন্ধদেশ স্থূল এবং স্বর গম্ভীর হইল।
উত্তম রূপে বিদ্যাশিক্ষা হইলে আচার্য্যেরা বিদ্যালয় হইতে গৃহে যাইবার অনুমতি দিলেন। তদনুসারে রাজা চন্দ্রাপীড়কে বাটীতে আনাইবার নিমিত্ত শুভ দিনে অনেক তুরঙ্গ, মাতঙ্গ, পদাতি সৈন্য, সমভিব্যাহারে দিয়া সেনাধ্যক্ষ বলাহককে বিদ্যামন্দিরে পাঠাইয়া দিলেন। সমাগত অন্যান্য রাজগণও চন্দ্রাপীড়ের দর্শনলালসায় বিদ্যালয়ে গমন করিলেন। বলাহক বিদ্যামন্দিরে প্রবেশিয়া রাজকুমারকে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, কুমার! মহারাজ কহিলেন, “আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে। তুমি সমস্ত শাস্ত্র, সকল কলা ও সমুদায় আয়ুধবিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ। এক্ষণে আচার্য্যেরা বাটী আসিতে অনুমতি দিয়াছেন। প্রজারা ও পরিজনেরা দেখিতে অতিশয় উৎসুক হইয়াছে। অতএব আমার অভিলাষ, তুমি অবিলম্বে বাটী আসিয়া দর্শনোৎসুক পরিজনদিগকে দর্শন দিয়া পরিতৃপ্ত কর এবং ব্রাহ্মণদিগের সমাদর, মানিলোকের মানরক্ষা, সন্তানের ন্যায় প্রজাদিগের প্রতিপালন ও বন্ধুবর্গের আনন্দোৎপাদন পূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্য সম্ভোগ কর।” আপনার আরোহণের নিমিত্ত মহরাজ ত্রিভুবনের এক অমূল্য রত্নস্বরূপ, বায়ু ও গরুড়ের ন্যায় অতিবেগগামী, ইন্দ্রায়ুধনামা অপূর্ব্ব ঘোটক প্রেরণ করিয়াছেন। ঐ ঘোটক সাগরের প্রবাহমধ্য হইতে উত্থিত হয়, পারস্যদেশের অধিপতি মহারত্ন ও আশ্চর্য্য পদার্থ বলিয়া উহা মহারাজকে উপহার দেন। অনেক অশ্বলক্ষণবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, উচ্চৈঃশ্রবার যে সকল সুলক্ষণ শুনিতে পাওয়া যায়, উহারও সেই সকল সুলক্ষণ আছে। ফলতঃ ইন্দ্রায়ুধ সামান্য ঘোটক নয়। আমরা ঐরূপ ঘোটক কখন দেখি নাই। দ্বারদেশে বদ্ধ আছে, অনুমতি হইলে আনয়ন করা যায়। দর্শনাভিলাষী রাজারাও সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া বাহিরে আপনার প্রতীক্ষা করিতেছেন।
বলাহক এই কথা কহিলে চন্দ্রাপীড় গম্ভীর স্বরে আদেশ করিলেন, ইন্দ্রায়ুধকে এই স্থানে লইয়া আইস। আজ্ঞামাত্র, অতি বৃহৎ, স্থূলকায়, মহাতেজস্বী, প্রচণ্ডবেগশালী, বলবান্ ইন্দ্রায়ুধ আনীত হইল। ঐ ঘোটক এরূপ বলিষ্ঠ ও তেজস্বী যে দুই বীর পুরুষ উভয় পার্শ্বে মুখের বল্গা ধরিয়াও উন্নমনের সময় মুখ নিম্ন করিয়া রাখিতে পারেন না, এরূপ উচ্চ যে, উন্নত পুরুষেরাও কর প্রসারিত করিয়া পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করিতে পারে না। চন্দ্রাপীড় সুলক্ষণসম্পন্ন অদ্ভুত অশ্ব অবলোকন করিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, অসুর ও দেবগণ সাগর মন্থন করিয়া কি রত্ন লাভ করিয়াছেন? দেবরাজ ইন্দ্র ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করেন নাই তাঁহার ত্রৈলোক্যাধিপত্যই বিফল। জলনিধি তাঁহাকে সামান্য উচ্চৈঃশ্রবা ঘোটক প্রদান করিয়া প্রতারণা করিয়াছেন। দেবাদিদেব নারায়ণ যদি ইহাকে একবার নেত্রগোচর করেন, বোধ হয় পক্ষিরাজ গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ জন্য তাঁহার আর অহঙ্কার থাকে না। পিতার কি আধিপত্য! ত্রিভুবনদুর্লভ এতাদৃশ রত্ন সকলও তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন। ইহার আকার ও লক্ষণ দেখিয়া বোধ হইতেছে, এ প্রকৃত ঘোটক নয়। কোন মহাত্মা শাপগ্রস্ত হইয়া অশ্বরূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবেন।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। অশ্বের নিকট উপস্থিত হইয়া মনে মনে নমস্কার ও আরোহণজন্য অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা পূর্ব্বক পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও বিদ্যালয় হইতে বহির্গত হইলেন। বহিঃস্থিত অশ্বারূঢ় নৃপতিগণ চন্দ্রাপীড়কে দেখিবামাত্র আপনাদিগকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং সাক্ষাৎকারলালসায় ক্রমে ক্রমে সকলেই সম্মুখে আসিতে লাগিলেন। বলাহক একে একে সকলের নাম ও বংশের নির্দ্দেশ পূর্ব্বক পরিচয় দিয়া দিল। রাজকুমার মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা যথোচিত সমাদর করিলেন। তাঁহাদিগের সহিত নানাপ্রকার সদালাপ করিতে করিতে সুখে নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। বন্দিগণ উচ্চৈঃস্বরে সুললিত মধুর প্রবন্ধে স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। ভৃত্যেরা চামর ব্যজন ও মস্তকে ছত্রধারণ করিল। বৈশম্পায়নও অন্য এক তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
চন্দ্রাপীড় ক্রমে ক্রমে নগরের মধ্যবর্ত্তী পথে সমাগত হইলেন। নগরবাসীরা সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক রাজকুমারের সুকুমার আকার অবলোকন করিতে লাগিল। নগরস্থ সমস্ত বাটীর দ্বার উদ্ঘাটিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, নগরী, চন্দ্রাপীড়কে দেখিবার নিমিত্ত একেবারে সহস্র সহস্র নেত্র উন্মীলন করিল। চন্দ্রাপীড় নগরে আসিতেছেন শুনিয়া রমণীগণ অতিশয় উৎসুক হইল এবং আপন আপন আরদ্ধ কর্ম্ম সমাপন না করিয়াই কেহ বা অলক্তক পরিতে পরিতে, কেহ বা কেশ বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বহির্গত হইয়া, কেহ বা প্রাসাদোপরি আরোহণ করিয়া এক দৃষ্টিতে পথ পানে চাহিয়া রহিল। একবারে সোপানপরম্পরায় শত শত কামিনীজনের অসম্ভ্রমে পাদনিঃক্ষেপ করায় প্রাসাদমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও অশ্রুতপূর্ব্ব ভূষণশব্দ সমুৎপন্ন হইল। গবাক্ষজালের নিকটে কামিনীগণের মুখপরম্পরা বিকসিত কমলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। স্ত্রীগণের চরণ হইতে আর্দ্র অলক্তক পতিত হওয়াতে ক্ষিতিতল পল্লবময় বোধ হইল। তাহাদিগের অঙ্গশোভায় নগর লাবণ্যময়, অলঙ্কারপ্রভায় দিগ্বলয় ইন্দ্রায়ুধময়, মুখমণ্ডলে ও লোচনপরম্পরায় গগনমণ্ডল চন্দ্রময়, পথ নীলোৎপলময় বোধ হইতে লাগিল। রাজকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি দেখিয়া বিলাসিনীগণ চমৎকৃত ও মোহিত হইয়া পরস্পর পরিহাস পূর্ব্বক কহিতে লাগিল সখি! এই পৃথিবীতে সেই ধন্য ও সৌভাগ্যবতী, এই পুরুষরত্ন যাহার কর গ্রহণ করিবেন। আহা! এরূপ পরমসুন্দর পুরুষ ত কখন দেখি নাই। বিধি বুঝি পুরুষনিধি করিয়া ইঁহার সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। যাহা হউক, আজি আমরা অঙ্গবিশিষ্ট অনঙ্গকে প্রত্যক্ষ করিলাম। ফলতঃ নির্ম্মল জলে ও স্বচ্ছ স্ফটিকে যেরূপ প্রতিবিম্ব পতিত হয়, সেইরূপ কামিনীগণের হৃদয়দর্পণে চন্দ্রাপীড়ের মোহিনী মূর্ত্তি প্রতিবিম্বিত হইল। রাজকুমার ক্ষণকাল পরে তাহাদিগের দৃষ্টির অগোচর হইলেন, হৃদয়ের অগোচর কোন কালেই হইতে পারিলেন না। রাজকুমার রাজবাটীর সমীপবর্ত্তী হইলে পৌরাঙ্গণারা পুষ্পবৃষ্টির ন্যায় তাঁহার মস্তকে মঙ্গললাজাঞ্জলি বর্ষণ করিল।